যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজে সৌদি শিক্ষার্থীকে নির্মমভাবে হত্যা

যুক্তরাজ্যের ঐতিহাসিক শহর কেমব্রিজে ২০ বছর বয়সী সৌদি শিক্ষার্থী মোহাম্মদ আল-কাসিমকে ছুরিকাঘাতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। ঘটনার তদন্তে ব্রিটিশ পুলিশের পাশাপাশি যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত সৌদি আরবের দূতাবাস ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে বলে নিশ্চিত করেছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। নিহত শিক্ষার্থী স্থানীয় একটি ভাষা প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে ১০ সপ্তাহের ইংরেজি কোর্সে অংশ নিচ্ছিলেন।
রাতের নিস্তব্ধতায় ঘটে গেল মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড
গত শুক্রবার রাতে কেমব্রিজ শহরের মিল পার্ক এলাকায় এ মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড ঘটে। রাত প্রায় ১১টা ৩০ মিনিটে আল-কাসিম ও তার এক সঙ্গীকে ছুরিকাঘাত করা হয়। খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছায় পুলিশ ও অ্যাম্বুলেন্স। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মোহাম্মদ আল-কাসিমের মৃত্যু হয় বলে নিশ্চিত করেন মেডিকেল কর্মকর্তারা।
এ ঘটনায় ২১ বছর বয়সী চাস কোরিগান নামে এক ব্রিটিশ তরুণকে হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সেইসঙ্গে, ৫০ বছর বয়সী এক ব্যক্তিকে অপরাধে সহায়তা করার সন্দেহে আটক করেছে পুলিশ।
নিহত শিক্ষার্থীর পরিচয় ও তার যুক্তরাজ্যে অবস্থান
মোহাম্মদ আল-কাসিম সৌদি আরব থেকে যুক্তরাজ্যে গিয়েছিলেন ইংরেজি ভাষা শিখতে। কেমব্রিজের একটি প্রতিষ্ঠানে ১০ সপ্তাহের কোর্সে অংশ নিচ্ছিলেন তিনি। পরিবার ও বন্ধুদের মতে, তিনি ছিলেন অত্যন্ত ভদ্র, বিনয়ী ও সদা হাস্যোজ্জ্বল এক যুবক, যিনি একটি স্বপ্ন নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন।
তার বোন এক আবেগঘন পোস্টে লিখেছেন, “সে ছিল এক হাজার পুরুষের সমান সাহসী। সে আমার মেরুদণ্ড ছিল। আমি তাকে নিয়ে গর্বিত এবং অপরিসীমভাবে ভালোবাসতাম। ভাইদের মধ্যে যেমন দ্বন্দ্ব হয়, আমাদের মধ্যে কখনও তা হয়নি।”
সৌদি দূতাবাসের পদক্ষেপ ও প্রতিক্রিয়া
ঘটনার পরপরই যুক্তরাজ্যে অবস্থিত সৌদি দূতাবাস এক বিবৃতিতে জানায়, তারা ব্রিটিশ পুলিশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে এবং মোহাম্মদ আল-কাসিমের মরদেহ সৌদি আরবে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
সৌদি আরবের চাচা মাজেদ আবালখাইল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, “আমার ভাগ্নের মৃত্যু আমাদের পুরো পরিবারের জন্য একটি অপূরণীয় ক্ষতি। আমরা আশা করি, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে।”
আদালতের সর্বশেষ আপডেট: গ্রেপ্তার ব্যক্তি রিমান্ডে
গ্রেপ্তার হওয়া চাস কোরিগানকে সোমবার পিটারবোরো ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। আদালত তাকে রিমান্ডে পাঠিয়েছে এবং মঙ্গলবার তাকে কেমব্রিজ ক্রাউন কোর্টে প্রাথমিক শুনানির জন্য উপস্থাপন করার কথা রয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, আরও একজন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তদন্তের পর এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হবে।
অনলাইন ও সামাজিক মাধ্যমে সহানুভূতি ও সহায়তা
নিহত শিক্ষার্থীর বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতজনেরা অনলাইনে তাদের শোক ও স্মৃতি ভাগাভাগি করছেন। এরই মধ্যে তারা একটি অনুদান সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু করেছেন, যাতে ৩০ হাজার রিয়াল (প্রায় ৮ হাজার ডলার) এর বেশি অর্থ সংগৃহীত হয়েছে। এই অর্থ মরদেহ পাঠানো এবং পরিবারের সহায়তায় ব্যয় করা হবে।
বিশ্বজুড়ে সৌদি কমিউনিটি এবং শিক্ষার্থী সংগঠনগুলোও আল-কাসিমের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে।
আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ
এই মর্মান্তিক ঘটনাটি যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত বিদেশি শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে। বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোর শিক্ষার্থী যারা ভাষা শিক্ষা বা উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমায়, তারা এ ঘটনায় আতঙ্কিত।
এক শিক্ষার্থী বলেন, “এটা কেবল একটি হত্যাকাণ্ড নয়, বরং আমাদের মতো হাজারো ছাত্রছাত্রীর মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে। আমরা আশা করি, ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তা জোরদার করবে এবং দ্রুত বিচার নিশ্চিত করবে।”
অতীতেও ঘটেছে এমন হামলা: পটভূমি বিশ্লেষণ
বিদেশি শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে যুক্তরাজ্যে এর আগেও সহিংসতা ও হামলার ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে কেমব্রিজ ও লন্ডনের মতো শহরে নানা সময়ে ভিন্ন ভাষাভাষী বা মুসলিম শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণের অভিযোগ উঠে এসেছে।
২০১৯ সালেও ম্যানচেস্টারে এক আরব শিক্ষার্থীকে গালাগাল ও শারীরিক আক্রমণের শিকার হতে হয়েছিল। যদিও ব্রিটিশ সরকার শিক্ষা ভিসাধারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে, তবে বাস্তবতায় চিত্র ভিন্ন।
বিশেষজ্ঞদের মতামত: এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা না, বরং সমাজের অসংবেদনশীলতার প্রতিফলন
ব্রিটেনভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ‘ইকুয়াল ভয়েস’ এর একজন বিশ্লেষক বলেন, “এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে যে বিদেশি শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা এখনও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ধর্মীয়, জাতিগত বা ভাষাগত পার্থক্যকে কেন্দ্র করে কিছু মানুষ সহিংস হয়ে উঠছে, যা উদ্বেগজনক।”
তিনি আরও বলেন, “এই হত্যাকাণ্ডটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে দায় এড়ানো যাবে না। ব্রিটিশ সমাজ ও প্রশাসনের উচিত, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আরও জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া।”
শেষ কথা
কেমব্রিজ শহরে সৌদি শিক্ষার্থী মোহাম্মদ আল-কাসিমের নির্মম মৃত্যু বিশ্ববাসীর হৃদয় স্পর্শ করেছে। একদিকে তার পরিবার শোকে মুহ্যমান, অন্যদিকে নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে শিক্ষার্থী সমাজ। তদন্তের ফল কী হবে, অপরাধীরা কেমন শাস্তি পাবে — সেটাই এখন সবার দৃষ্টি আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
এম আর এম – ০৭২৩, Signalbd.com