অস্কারজয়ী ফিলিস্তিনি চলচ্চিত্রকর্মী আওদাহ’র মরদেহ আটক করে রেখেছে ইসরায়েল

ফিলিস্তিনি চলচ্চিত্রকর্মী ও মানবাধিকারকর্মী আওদাহ হাথালিনকে হত্যার পর তার মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর না করে আটকে রেখেছে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ। এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এটি এক ধরনের ‘মানসিক নিপীড়নের কৌশল’, যার মাধ্যমে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের প্রতিবাদী চেতনা দমন করতে চায়।
ঘটনাটির বিস্তারিত
৩১ বছর বয়সী আওদাহ হাথালিন দক্ষিণ পশ্চিম তীরের মাসাফের ইয়াত্তার উম্ম আল-খাইর গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন।
গত ২৮ জুলাই স্থানীয় সময় সকাল বেলায় ওই গ্রামের কমিউনিটি সেন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় এক ইসরায়েলি সেটেলার তার বুকে গুলি করে। ঘটনাস্থলেই মারা যান আওদাহ।
গ্রামবাসীদের দাবি, তাকে হত্যা করেছে ইনোন লেভি নামের এক ইসরায়েলি সেটেলার, যিনি একটি অবৈধ বসতিতে বসবাস করেন এবং এর আগেও সহিংসতার অভিযোগে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েছেন।
আওদাহ ও তার সংগ্রাম
আওদাহ হাথালিন শুধু একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের জমি, ঘরবাড়ি ও অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামের প্রতীক।
তিনি যুক্ত ছিলেন “নো আদার ল্যান্ড” নামের একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে, যা ইসরায়েলি দখলদারিত্বের নির্মমতা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরে।
এই প্রামাণ্যচিত্রটি চলতি বছর অস্কার পুরস্কার লাভ করে, যা ফিলিস্তিনি শিল্প-সংস্কৃতির জন্য ছিল এক ঐতিহাসিক সাফল্য। কিন্তু তার অল্প কিছুদিন পর থেকেই মাসাফার ইয়াত্তায় ইসরায়েলি সেনা ও সেটেলারদের সহিংসতা বেড়ে যায়।
এমনকি, এই বছরের মার্চে আরেক নির্মাতা হামদান বালালকেও সেটেলাররা মারধর করে, পরে তাকে ইসরায়েলি সেনারা গ্রেফতার করে।
মরদেহ আটকে রাখার রাজনীতি
ফিলিস্তিনি নেটওয়ার্ক ‘আল-শাবাকাহ’র সহনির্বাহী পরিচালক ফাতিহি নিমের অভিযোগ করেছেন, ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ আওদাহ’র মরদেহ আটক রেখে তার পরিবার ও গ্রামের মানুষের মনোবল ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
তিনি বলেন, “এটি শুধু শোক থেকে বঞ্চিত করার কৌশল নয়, এটি প্রতিরোধ আন্দোলনের মনোবল দমন করার অংশ।”
তার দাবি, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বর্তমানে একটি গোপন কবরস্থানে শতাধিক ফিলিস্তিনির মরদেহ আটকে রেখেছে এবং এগুলো দাফনের অনুমতি পর্যন্ত দিচ্ছে না।
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ নাকি মরদেহ ফেরতের শর্ত হিসেবে আওদাহ’র জানাজায় মাত্র ১৫ জন অংশগ্রহণ করতে পারবে এমন শর্ত দিচ্ছে, যা পরিবার ও সম্প্রদায়ের পক্ষে গ্রহণযোগ্য নয়।
স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া
উম্ম আল-খাইর গ্রামের বাসিন্দারা আওদাহ’র হত্যার ঘটনাকে ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিত খুন বলেই মনে করছেন।
গ্রামের এক প্রবীণ সদস্য বলেন, “আওদাহ ছিল আমাদের কণ্ঠস্বর। তাকে হত্যা করে আমাদের দমন করতে চাইছে। এখন মরদেহ না দিয়ে তারা আমাদের আত্মিকভাবে ভেঙে দিতে চায়।”
আওদাহর মা ও ভাই সংবাদমাধ্যমকে জানান, তারা কেবল সন্তানের মরদেহ ফিরিয়ে নিয়ে সম্মানের সঙ্গে দাফন করতে চান।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও নিন্দা
মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ ঘটনাকে ‘মানবাধিকারের লঙ্ঘন’ হিসেবে অভিহিত করেছে।
তারা বলছে, একটি রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর হাতে কোনো নাগরিক নিহত হওয়ার পর মরদেহ আটকে রাখা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘনের শামিল।
জাতিসংঘের একাধিক পর্যবেক্ষক সংস্থা এ বিষয়ে নোটিশ দিলেও এখনো পর্যন্ত কোনো কার্যকর আন্তর্জাতিক চাপ ইসরায়েলের ওপর সৃষ্টি হয়নি।
ফাতিহি নিমের বলেন, “এই বসতকারীরা একা নয়। তারা রাষ্ট্রীয় এবং সামরিক সহায়তা পাচ্ছে। ফলে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ছাড়া এই ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধ হবে না।”
বিশেষজ্ঞ মতামত
মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইসরায়েলের এই নতুন কৌশল শুধু রাজনৈতিক নয়, এটি এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টির কৌশল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুব হাসান বলেন, “মরদেহ আটকে রাখা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের শামিল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিরবতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।”
শেষকথা
আওদাহ হাথালিনের মৃত্যু ও মরদেহ আটকে রাখার ঘটনা আবারও বিশ্ববাসীর সামনে ইসরায়েলের দখলদার নীতির নির্মমতা তুলে ধরেছে।
প্রতিদিনের সহিংসতা, বসতিস্থাপন, এবং মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনের মধ্যে দিয়ে ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে।
তবে প্রশ্ন থেকে যায়—আওদাহ’র মৃত্যুর পরও কি তার প্রতিরোধের চেতনা থেমে যাবে? নাকি তার মৃত্যুই আরও অনেক আওদাহকে জাগিয়ে তুলবে?
এম আর এম – ০৬৭৯, Signalbd.com