বিশ্ব

থাইল্যান্ড কম্বোডিয়া সীমান্তে সংঘর্ষ, নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দুটি প্রতিবেশী দেশ থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে সীমান্তে ফের তীব্র সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে। শুক্রবার সকাল থেকে শুরু হওয়া এই সংঘর্ষে দুই দেশের সামরিক বাহিনী একে অপরের বিরুদ্ধে ভারী অস্ত্র ব্যবহার করেছে বলে জানা গেছে। কম্বোডিয়ার সেনারা বিএম-২১ গ্র্যাড রকেট লঞ্চার ব্যবহার করে থাইল্যান্ডের সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে। থাইল্যান্ডের পক্ষ থেকে পাল্টা এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে কম্বোডিয়ার সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে বোমা হামলা চালানো হয়েছে।

এই সংঘর্ষে অন্তত ১১ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং অনেকে আহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে রয়েছে এক আট বছরের শিশু। পরিস্থিতি তীব্র হওয়ায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ আজ এই বিষয় নিয়ে জরুরি বৈঠকের আয়োজন করেছে।

সংঘর্ষের পটভূমি: পুরনো সীমান্ত বিবাদ

থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরে বিতর্কিত। বিশেষ করে কম্বোডিয়ার ওদ্দার মিনচেই প্রদেশের তা মোয়ান থম মন্দির এলাকায় দুই দেশের মাঝে সার্বভৌমত্ব নিয়ে টানাপোড়েন রয়েছে। এ অঞ্চল নিয়ে দুই দেশের মাঝে বহু বছর ধরে সীমান্ত বিবাদ চলছিল, যা মাঝে মাঝে সামরিক সংঘর্ষের রূপ নিয়েছে।

গত কয়েক মাস ধরে সীমান্ত এলাকায় উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছিল। মে মাসের শেষ দিকে সংক্ষিপ্ত সংঘর্ষে এক কম্বোডিয়ান সেনা নিহত হওয়ার পর থেকে উভয় দেশের মধ্যে সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি পেয়েছিল। সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সেনারা একে অপরের বিরুদ্ধে ভারী অস্ত্র মোতায়েন করেছে।

সংঘর্ষের বিবরণ: রকেট হামলা থেকে বিমান হামলা

থাই সেনাবাহিনী জানিয়েছে, কম্বোডিয়ার সেনারা বিএম-২১ রকেট সিস্টেমসহ ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে ধারাবাহিক গোলাবর্ষণ চালিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে থাই সেনারা পাল্টা প্রতিহিংসামূলক অভিযান চালিয়ে ছয়টি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান মোতায়েন করেছে। এর মধ্যে একটি যুদ্ধবিমান কম্বোডিয়ার সামরিক ঘাঁটিতে বোমা হামলা চালায়। থাই সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিমান হামলার লক্ষ্য ছিল সুনির্দিষ্ট সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা।

সীমান্তে অন্তত ছয়টি আলাদা স্থানে গোলাবর্ষণ ছড়িয়ে পড়েছে। গোলাবর্ষণের কারণে থাইল্যান্ডের তিনটি প্রদেশে ১২ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ১১ জন বেসামরিক ব্যক্তি। আহত হয়েছেন আরও ৩১ জন। কম্বোডিয়ার হতাহতের বিস্তারিত তথ্য এখনও প্রকাশ পায়নি।

বেসামরিক প্রাণহানি ও মানবিক দুর্যোগ

সীমান্তে সংঘর্ষের ফলে বেসামরিক মানুষের উপর ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে। থাইল্যান্ডের স্বাস্থ্যমন্ত্রী সোমসাক থেপসুথিন গোলাবর্ষণকে ‘যুদ্ধাপরাধ’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, সুরিন প্রদেশের একটি হাসপাতালে গোলাগুলি হয়েছে, যেখানে অসংখ্য আহত মানুষের চিকিৎসা চলছে।

সীমান্তবর্তী গ্রামগুলো থেকে শিশু, বৃদ্ধ ও নারীরা বালির বস্তা ও টায়ারে ঘেরা কংক্রিটের বাংকারে আশ্রয় নিয়েছেন, তীব্র গোলাবর্ষণের ভয়ে জীবন বাঁচাতে পালাচ্ছেন হাজারো পরিবার।

কূটনৈতিক উত্তেজনা ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

গত বুধবার থাইল্যান্ড তার রাষ্ট্রদূতকে কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেন থেকে প্রত্যাহার করেছে এবং একই সাথে কম্বোডিয়ার রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করেছে। এর আগে থাই সেনাবাহিনীর একজন সদস্য স্থলমাইন বিস্ফোরণে পা হারানোর ঘটনাও সংঘটিত হয়। থাইল্যান্ড দাবি করে, মাইনটি কম্বোডিয়ার বাহিনী সম্প্রতি সীমান্তে পুঁতে রেখেছিল, তবে কম্বোডিয়া এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে এবং এটিকে ‘মিথ্যা’ আখ্যা দিয়েছে।

কম্বোডিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংঘর্ষকে ‘বেপরোয়া ও নৃশংস সামরিক আগ্রাসন’ হিসেবে অভিহিত করেছে। একই সাথে কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন মানেত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে পাঠানো একটি চিঠিতে থাইল্যান্ডের বিরুদ্ধে ‘অভিযোগহীন ও পূর্বপরিকল্পিত সামরিক আগ্রাসনের’ অভিযোগ তুলেছেন এবং আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন উল্লেখ করে নিরাপত্তা পরিষদকে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন।

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক

এই উত্তেজনার মধ্যেই আজ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সংঘর্ষ নিয়ে জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বৈঠকে দুই দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হবে এবং সম্ভাব্য শান্তিপূর্ণ সমাধানের উপায় খোঁজা হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ ও আহ্বান

থাইল্যান্ডের দীর্ঘদিনের মিত্র যুক্তরাষ্ট্র সহিংসতা বৃদ্ধি পাওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের উপমুখপাত্র টমি পিগট বলেন, “আমরা থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সীমান্তে সহিংসতা বৃদ্ধি এবং বেসামরিক মানুষের ক্ষতির খবর পেয়ে শোকাহত। অবিলম্বে সংঘর্ষ বন্ধ, বেসামরিক সুরক্ষা নিশ্চিত এবং সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য আমরা আহ্বান জানাচ্ছি।”

ভবিষ্যৎ

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই সংঘর্ষ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় ধাক্কা। দীর্ঘদিন ধরে চলা সীমান্ত বিরোধের পেছনে রয়েছে ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক বিভিন্ন কারণ। থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার উভয় পক্ষই সামরিক ও কূটনৈতিক পর্যায়ে নিজেদের অবস্থান কঠোর করে রেখেছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য দুই দেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা প্রয়োজন। অন্যথায়, এই সংকট আরও দীর্ঘায়িত হয়ে সশস্ত্র সংঘাতে রূপ নিতে পারে, যা পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তা ও অর্থনীতির জন্য মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।

থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া সীমান্তে এই নতুন সংঘর্ষ, হাজার হাজার বেসামরিক মানুষের জীবন বিপন্ন করে তুলেছে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শান্তি প্রক্রিয়াকে হুমকির মুখে ফেলেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত দ্রুত নিরপেক্ষ ভূমিকা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া। শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে না পারলে, এই সংকটের বহুমাত্রিক প্রভাব দিকদর্শন করা কঠিন হবে।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Advertisement
Back to top button