ভারতের নতুন সংসদ ভবনের বর্ষাকালীন অধিবেশন শুরু হয়েছে, কিন্তু প্রথম দিন থেকেই পাকিস্তানে পেহেলগাম হামলা ও অপারেশন সিঁদুর নিয়ে উত্তপ্ত বিতর্কে ম্লান হয়ে গেছে পার্লামেন্টের কার্যক্রম। বিরোধীরা সরকারের কাছে কঠোর প্রশ্ন তুলে তাদের জবাবদিহি দাবি করলেও, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও সরকারের পক্ষ থেকে চুপ করে থাকার প্রবণতা চোখে পড়েছে।
পার্লামেন্ট অধিবেশন শুরু, শুরুতেই বিরোধীদের সরব প্রশ্ন
আজ সোমবার ভারতের সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশন শুরু হলেও, বিরোধীরা পেহেলগাম হামলা ও অপারেশন সিঁদুর নিয়ে সরব হয়ে ওঠেন। গোয়েন্দা ব্যর্থতা, যুদ্ধবিমান ক্ষয়ক্ষতির সত্যতা, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতাসহ নানা প্রশ্ন তুলতে গিয়ে দুই কক্ষেই কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। বিরোধীদের দাবির বিরুদ্ধে সরকার দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে।
পেহেলগাম হামলা ও অপারেশন সিঁদুর: প্রশ্নবাণের মুখে মোদি সরকারের কঠিন অবস্থান
২০২৫ সালের ১০ মে পেহেলগামে এক সশস্ত্র হামলার ঘটনা দেশজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। ভারতের প্রতিরক্ষা বাহিনী ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে ওই হামলার প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বড় ধরনের সামরিক অভিযান চালায়। কিন্তু যুদ্ধ শুরু থেকে মাত্র চার দিন পরই হঠাৎ করেই যুদ্ধবিরতি ঘোষণা আসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায়।
ট্রাম্প বারবার দাবি করেছেন, তাঁর হুমকির কারণেই ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি মানতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু ভারতের ঐতিহ্যগত নীতির বিরুদ্ধে এই তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপের কথা স্বীকার করা হয়নি। এ নিয়ে বিরোধীরা কঠোর প্রশ্ন তুললেও মোদি সরকার কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয়নি।
যুদ্ধবিমান ক্ষয়ক্ষতির বিতর্ক: সত্যের মুখোমুখি ভারত?
পাকিস্তান দাবি করেছে, এই যুদ্ধে ভারতের কয়েকটি যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়েছে। যদিও ভারতীয় চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ জেনারেল অনিল চৌহান ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে ‘যুদ্ধের স্বাভাবিক অংশ’ বলে বিষয়টি ছোট করার চেষ্টা করেছেন। তবুও বিরোধীরা এটিকে লুকানোর চেষ্টা বলে অভিযোগ করেন।
ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মন্তব্যে অন্তত পাঁচটি যুদ্ধবিমানের ক্ষয়ক্ষতির কথাও উঠে এসেছে, যদিও কোন দেশের তা স্পষ্ট করেননি। বিরোধীরা মোদির কাছে সরাসরি এই বিষয়ে জবাব চেয়েছেন, কিন্তু এখনো পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী সংসদে কোনো স্পষ্ট উত্তর দেননি।
নির্বাচন কমিশন ও ভোটার তালিকা সংশোধন নিয়ে নতুন বিতর্ক
পেহেলগাম হামলা ও যুদ্ধবিরতির বাইরেও ভারতের নির্বাচনী ব্যবস্থায় নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিহারের ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত তৎপরতার অভিযোগ উঠেছে। বিরোধীরা বলছেন, ভোটার তালিকা সংশোধন একটি গোপনভাবে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (NRC) তৈরির প্রয়াস।
এই বিতর্ক বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টেও বিবেচনাধীন। বিরোধীরা এ নিয়ে সরকারকে প্রশ্নের মুখোমুখি করতে চান, কিন্তু সরকারকে কি বিরোধীদের এসব প্রশ্নের জবাব দিতে হবে, তা নিয়েই সংশয় রয়েছে।
সর্বদলীয় বৈঠকেও মোদির সরাসরি উপস্থিতি নেই
গত রোববার পার্লামেন্টের সর্বদলীয় বৈঠক হয় যেখানে বিরোধীদের দাবি আলোচনার জন্য সরকার সম্মতি দেয়। কিন্তু এই বৈঠকে নিজে না গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদি দায়িত্ব দেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংকে। ফলে, পার্লামেন্টে পেহেলগাম-অপারেশন সিঁদুর নিয়ে সরাসরি জবাবদিহি হবে কি না, তা প্রশ্নবিদ্ধ।
রাজনাথ সিং ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে এই বিতর্কে মুখোমুখি করার সম্ভাবনা রয়েছে, বিশেষ করে বিদেশে ভারতের সর্বদলীয় প্রতিনিধিদের পাঠানো নিয়ে বিরোধীদের প্রশ্ন উঠেছে।
মোদি সরকারের গত ১১ বছরের পার্লামেন্ট জবাবদিহি: একবারও বিরোধীদের প্রশ্নের সম্মুখীন হননি
গত এক দশকের বেশি সময় ধরে মোদি একবারও সংসদে বিরোধীদের বিতর্কিত প্রশ্নের জবাব দেননি। বিরোধীদের আনীত মুলতবি প্রস্তাব একটিও গৃহীত হয়নি। বরং তাদের বক্তব্য প্রাতিষ্ঠানিক নথি থেকেও বাদ দেওয়া হয়েছে।
এই অধিবেশনে বিরোধীরা মোদিকে সরাসরি জবাবদিহির জন্য চাপ দিচ্ছেন, তবে সে ক্ষেত্রে কি পার্লামেন্টে মোদি মুখ খুলবেন, সেটাই এখন প্রধান আকর্ষণ।
পার্লামেন্ট অধিবেশনের প্রথম সপ্তাহে মোদির বিদেশ সফর: বিরোধীদের জন্য বড় বাধা
এই অধিবেশনের প্রথম সপ্তাহেই প্রধানমন্ত্রী মোদি যুক্তরাজ্য ও মালদ্বীপে চার দিনের সরকারি সফরে যাবেন। ফলে বিরোধীরা প্রধানমন্ত্রীকে পার্লামেন্টে প্রশ্নের মুখোমুখি করার সুযোগ পাবে না।
তবে, সংসদের বাইরে মোদি বলেন, “পুরো বিশ্ব ভারতের সামরিক শক্তির পরিচয় পেয়েছে,” যা যুদ্ধবিরতি ও সামরিক অভিযানের প্রেক্ষিতে দেশের শক্তি প্রদর্শনের ইঙ্গিত বহন করে।
সামগ্রিক বিশ্লেষণ:
পেহেলগাম হামলা, অপারেশন সিঁদুর ও যুদ্ধবিরতি নিয়ে উঠা বিতর্ক শুধুমাত্র ভারতীয় সংসদে নয়, আন্তর্জাতিক মঞ্চেও নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ট্রাম্পের মধ্যস্থতাকে স্বাগত না জানিয়ে ভারতের নিজস্ব নীতির প্রতি অটল থাকার অবস্থান বিরোধীদের সন্দেহ বাড়িয়েছে। নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম নিয়েও রাজনৈতিক চাপ বাড়ছে।
প্রধানমন্ত্রী মোদি ও তার সরকারের জন্য পার্লামেন্টে বিরোধীদের কঠোর প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া নতুন চ্যালেঞ্জ। তবে, আদৌ তিনি বা তাঁর সরকার পার্লামেন্টে এই বিতর্কের উত্তরে মুখ খুলবেন কি না, সেটাই আগামী অধিবেশনের প্রধান আকর্ষণ হিসেবে রইল।



