বিশ্ব

যুদ্ধকালীন সাইবার হামলায় ইরানের দুটি প্রধান ব্যাংকের ডেটা ধ্বংস

Advertisement

 ইরান-ইসরায়েল ১২ দিনের যুদ্ধে ভয়াবহ সাইবার হামলার শিকার হয় ইরানের দুটি শীর্ষস্থানীয় ব্যাংক সেপাহ ও পাসারগাদ। এই হামলায় ব্যাংকগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ডেটা ধ্বংস হয়ে যায়, ফলে পুরো দেশে ব্যাংকিং সেবা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সফটওয়্যার কোম্পানি এবং অর্থনৈতিক অবকাঠামো চরম ক্ষতির মুখে পড়ে।

ব্যাংকিং ডেটা একেবারে মুছে গেছে

সম্প্রতি ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার ১২ দিনের যুদ্ধের সময় ঘটে যায় একটি নজিরবিহীন সাইবার হামলা। হামলার প্রধান লক্ষ্য ছিল ইরানের দুটি বৃহৎ রাষ্ট্রীয় ব্যাংক—সেপাহ এবং পাসারগাদ। এই দুই ব্যাংকের ব্যাংকিং ডেটা একেবারে ধ্বংস হয়ে যায়, যা ইরানের অর্থনৈতিক নিরাপত্তায় বড় ধরনের আঘাত হানে।

সাইবার হামলার ফলে তাৎক্ষণিকভাবে দেশব্যাপী ব্যাংকিং সেবা বন্ধ হয়ে যায়। ইন্টারনেট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং, এমনকি এটিএম কার্যক্রম পুরোপুরি অচল হয়ে পড়ে। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয়, এই হামলার ফলে ডেটার ব্যাকআপ সাইটও অকেজো হয়ে পড়ে।

ডটিন সফটওয়্যারের প্রধান ভূমিকা

এই সাইবার হামলার সময় ইরানের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংক সফটওয়্যার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ডটিন ছিল পরিস্থিতির কেন্দ্রবিন্দুতে। ডটিনের ডেপুটি হেড অফ প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট হামিদরেজা আমুজেগার লিঙ্কডইনে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেন, “সিস্টেমে কিছুই কাজ করছিল না, কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। এমনকি ব্যাকআপ সাইটেও একই অবস্থা।”

সেপাহ ব্যাংকের মূল ডেটা সেন্টার সম্পূর্ণরূপে খালি হয়ে গিয়েছিল। মনিটরিং ড্যাশবোর্ড জমে গিয়েছিল এবং সমস্ত সংরক্ষিত তথ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, ডিজাস্টার রিকভারি সাইটও এই বিপর্যয় এড়াতে ব্যর্থ হয়।

এক মাস ধরে স্থবির ছিল ব্যাংকিং সেবা

এই সাইবার হামলার পর প্রায় এক মাস ধরে সেপাহ ও পাসারগাদ ব্যাংকের ডিজিটাল সেবা বন্ধ ছিল। ব্যবহারকারীরা কোনোভাবেই অনলাইন ব্যাংকিং, মোবাইল অ্যাপ কিংবা এটিএম ব্যবহার করতে পারেনি। এতে সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে সরকারি ও সামরিক কর্মকাণ্ড পর্যন্ত বিঘ্নিত হয়।

বিশেষ করে সেপাহ ব্যাংক, যারা ইরানি সামরিক বাহিনীর বেতন প্রক্রিয়াকরণে ব্যবহৃত হয়, সেই ব্যাংকের স্থবিরতা পুরো ব্যবস্থাপনাকে দুর্বল করে তোলে। অন্যদিকে পাসারগাদ ব্যাংক তুলনামূলকভাবে দ্রুত সেবা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়, কারণ তারা আগে থেকেই বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল।

আর্থিক দিক থেকে বিপর্যয়

প্রতিমাসে এক বিলিয়নেরও বেশি লেনদেন সম্পন্ন করে এমন ব্যাংকের ক্ষেত্রে একদিনের ডেটা হারানোর অর্থ প্রায় ৩০ মিলিয়ন লেনদেন হারানো। সেপাহ ব্যাংক পুরোপুরি সচল হতে সময় নেয় ২৭ জুন পর্যন্ত। এই সময়ে স্যামসোনাইট নামক একটি পোর্টেবল ডেটা সেন্টারের মাধ্যমে ৬০ মিলিয়নেরও বেশি লেনদেন প্রক্রিয়া করা হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেটা সেন্টার ধ্বংস হলে শুধু আর্থিক ক্ষতিই নয়, দেশটির নিরাপত্তা এবং ডিজিটাল অবকাঠামোর ওপরও মারাত্মক প্রভাব পড়ে। এই ধরনের হামলার প্রভাবে পুনরুদ্ধারে মাসের পর মাস লেগে যেতে পারে।

‘প্রেডেটরি স্প্যারো’ নামক হ্যাকার গ্রুপের দাবি

ইসরায়েলপন্থী হ্যাকার গ্রুপ ‘প্রেডেটরি স্প্যারো’ এই সাইবার হামলার দায় স্বীকার করেছে। তারা দাবি করে, সেপাহ ব্যাংকের সিস্টেম সম্পূর্ণ অচল করে দেওয়া হয়েছে এবং নোবিটেক্স নামক ইরানের একটি প্রধান ক্রিপ্টোকারেন্সি এক্সচেঞ্জ থেকে ৯০ মিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ চুরি করা হয়েছে।

এই হ্যাকার গ্রুপ ইতিপূর্বেও ইরানের জ্বালানি অবকাঠামোতে হামলা চালিয়েছিল বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সাইবার নিরাপত্তা গবেষকরা। এই ঘটনার ফলে ইরানের ডিজিটাল নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে।

সাইবার যুদ্ধ নতুন বাস্তবতা

বিশ্লেষকদের মতে, সাইবার যুদ্ধ এখন আর কল্পনার বিষয় নয়, বরং আধুনিক যুদ্ধেরই একটি অংশ। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও আর্থিক অবকাঠামো এখন সরাসরি টার্গেটে পরিণত হচ্ছে। ইরানের এই ব্যাংকিং হামলা তা প্রমাণ করলো।

ডিজিটাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার যত বেশি কেন্দ্রীভূত ও নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে, ততই সাইবার হামলার ঝুঁকি বাড়ছে। ভবিষ্যতে এমন হামলা ঠেকাতে আন্তর্জাতিক নীতিমালা এবং শক্তিশালী সাইবার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সারসংক্ষেপ ও ভবিষ্যতের দৃষ্টিভঙ্গি

ইরান-ইসরায়েল সাইবার যুদ্ধের এই পর্ব দেখিয়ে দিল, যুদ্ধ এখন শুধু মাঠে নয়, চলছে ভার্চুয়াল জগতে। ব্যাংকিং অবকাঠামো ভেঙে পড়া মানে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, বরং জনগণের জীবনের সরাসরি উপরেও প্রভাব পড়ে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, “সাইবার যুদ্ধ যুদ্ধবিরতির তিন দিন পর শেষ হলেও, পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া চলবে আরও বহু মাস।” প্রশ্ন উঠছে—আগামী দিনে সাইবার হামলার হাত থেকে রক্ষা পেতে প্রস্তুত কি বিশ্ব?

এম আর এম – ০৪২৬, Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button