
বাংলাদেশ ও চীনের অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও প্রযুক্তিগত সম্পর্ক আরও মজবুত করতে রাজধানী ঢাকায় শুরু হয়েছে দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ ইন বাংলাদেশ এক্সিবিশন ২০২৫’ (BRI Exhibition 2025)। আন্তর্জাতিক কনভেনশন সিটি বসুন্ধরায় (আইসিসিবি) অনুষ্ঠিত এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন।
এই প্রদর্শনীতে চীনের বিভিন্ন শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে, যা বাংলাদেশে বিনিয়োগ এবং বাণিজ্য সম্প্রসারণের নতুন সম্ভাবনা উন্মোচন করবে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উচ্চপদস্থ অতিথিরা
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. সবুর হোসেন, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মিরানা মাহরুখ, এবং চীনা এন্টারপ্রাইজেস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হান কুন।
শেখ বশিরউদ্দীন উদ্বোধনী বক্তব্যে বলেন, “বাংলাদেশ-চীনের বন্ধুত্ব ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক শুধুমাত্র দুই দেশের মধ্যে নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এক নতুন বাণিজ্য দিগন্ত তৈরি করছে। আমরা চাই চীনা বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে মানসম্মত শিল্প স্থাপন করে, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং প্রযুক্তি স্থানান্তর নিশ্চিত করুক।”
তিনি আরও বলেন, “বর্তমান সড়ক দুর্ঘটনা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। নিম্নমানের বাণিজ্যিক যানবাহন জনজীবনে বিপদের কারণ। যদি চীনা কোম্পানিগুলো মানসম্পন্ন যানবাহন উৎপাদন ও সরবরাহে যুক্ত হয়, তাহলে সড়ক নিরাপত্তা উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হবে।”
চীনা রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য: বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের নতুন অধ্যায়
রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, “দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম যেটি বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (BRI) সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে। গত এক বছরে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ ২৫৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণে আরও সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন, “চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে অবকাঠামো, প্রযুক্তি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, স্বাস্থ্য, কৃষি এবং পরিবহন খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে আগ্রহী। এটি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে দ্রুত অর্ধ-ট্রিলিয়ন ডলারের সীমা থেকে এক ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে সহায়ক হবে।”
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক লক্ষ্য ও চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশ বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি প্রসঙ্গও উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, “প্রতিবছর বাংলাদেশ চীন থেকে প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে, অথচ রপ্তানি তুলনামূলকভাবে অনেক কম। আমাদের রপ্তানিকে বৈচিত্র্যময় করতে এবং নতুন বাজার সৃষ্টি করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।”
অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চীনের বিনিয়োগ কেবল অবকাঠামো উন্নয়নেই নয়, প্রযুক্তি স্থানান্তর এবং উচ্চমানের শিল্প উৎপাদনের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও প্রযুক্তি খাতে চীনা বিনিয়োগ
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. সবুর হোসেন বলেন, “বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে চীনা বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে চায়। সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি এবং বায়োগ্যাস প্রকল্পে চীনা প্রযুক্তি ও বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।”
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মিরানা মাহরুখ বলেন, “বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য। BRI প্রদর্শনী বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক সহযোগিতার জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করবে।”
প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ ও কার্যক্রম
এবারের প্রদর্শনীতে মোট ৪০টি প্রতিষ্ঠান তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে, যার মধ্যে ৩২টি চীনের প্রতিষ্ঠান। ৮০টি বুথে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্য, প্রযুক্তি এবং সেবা প্রদর্শন করছে।
মূল খাতগুলো:
- অবকাঠামো ও নির্মাণ
- প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন
- নবায়নযোগ্য জ্বালানি
- স্বাস্থ্যসেবা ও মেডিকেল প্রযুক্তি
- কৃষি ও খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ
- পরিবহন ও লজিস্টিকস
- উৎপাদন ও শিল্প সামগ্রী
প্রদর্শনীতে উচ্চপর্যায়ের B2B ও G2B মিটিং, সেমিনার এবং বিনিয়োগ সংক্রান্ত বিশেষ সেশন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য প্রদর্শনী উন্মুক্ত থাকবে।
BRI প্রদর্শনীর প্রভাব: অর্থনীতি ও বিনিয়োগ
বিশ্ববাণিজ্য বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশ-চীন বাণিজ্য সম্প্রসারণে BRI প্রদর্শনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতি ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বাড়ালে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে, প্রযুক্তি স্থানান্তর হবে, এবং রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আসবে।
প্রদর্শনীটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চিত্রের জন্য একটি পাইলট মডেল হিসেবে কাজ করবে। নতুন বিনিয়োগ ও চীনা প্রযুক্তি গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ দ্রুত উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে পারবে।
দেশের জন্য নতুন সুযোগ
শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, “চীনা বিনিয়োগকারীরা যদি আমাদের সাথে যৌথভাবে শিল্প ও অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করে, তবে তা শুধু বাণিজ্যিক লাভ নয়, সামাজিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। আমরা চাই, দেশীয় উদ্যোক্তাদের সাথে যৌথ উদ্যোগে নতুন কর্মসংস্থান, নতুন প্রযুক্তি এবং উচ্চমানের পণ্য উৎপাদন নিশ্চিত হোক।”
রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনও বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ায় বিনিয়োগের মূল কেন্দ্র হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “চীনা কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশ করে কেবল বিনিয়োগ করবে না, বরং প্রযুক্তি স্থানান্তর, জ্ঞান ভাগাভাগি এবং স্থানীয় অর্থনীতি উন্নয়নেও ভূমিকা রাখবে।”
ঢাকায় অনুষ্ঠিত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এক্সিবিশন ২০২৫ বাংলাদেশ-চীন বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। প্রদর্শনীতে চীনা বিনিয়োগ, প্রযুক্তি স্থানান্তর, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, কৃষি, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামো খাতে সহযোগিতার সুযোগ চিহ্নিত হয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই ধরনের উদ্যোগ বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্তিশালী করবে, রপ্তানি বাড়াবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং প্রযুক্তি খাতে আধুনিকীকরণ আনবে।
বাংলাদেশ ও চীনের অংশীদারিত্ব শুধু বাণিজ্যিক নয়, বরং প্রযুক্তি, সমাজকল্যাণ ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রেও নতুন অধ্যায়ের সূচনা করছে।
MAH – 12793 Signalbd.com