ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে চাঞ্চল্যকর দাবি করেছেন, যে ইসরায়েল তাকে হত্যার চেষ্টা করেছিল। মার্কিন রক্ষণশীল টিভি ব্যক্তিত্ব টাকার কার্লসনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি এই তথ্য প্রকাশ করেন। সাক্ষাৎকারে পেজেশকিয়ান তার দেশের পারমাণবিক নীতি, মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত এবং যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্ক নিয়েও সরল ও স্পষ্ট মন্তব্য করেন।
ইসরায়েল আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল: পেজেশকিয়ানের ভয়ঙ্কর দাবি
ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান টাকার কার্লসনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বলেন, “ইসরায়েল আমাকে হত্যার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে।” যদিও তিনি কখন এবং কোথায় এই ঘটনা ঘটেছিল স্পষ্ট করেননি, তবে উল্লেখ করেছেন, “আমি একটি বৈঠকে ছিলাম যেখানে তারা বোমা হামলা চালানোর চেষ্টা করেছিল।”
এই মন্তব্য মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত রাজনীতির প্রেক্ষাপটে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ইসরায়েল-ইরান দ্বন্দ্ব বহু বছর ধরে চলমান। বিশেষত পারমাণবিক কর্মসূচি ও প্রতিরক্ষায় নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে টানাপোড়েন বৃদ্ধি পেয়েছে।
ইরানের পারমাণবিক নীতি: শান্তিপ্রিয়তা ও ধর্মীয় বিধিনিষেধ
পেজেশকিয়ান সাক্ষাৎকারে বারবার জোর দিয়ে বলেন, ইরান কখনও পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে চায়নি। তিনি বলেন, “পারমাণবিক বোমা ধর্মীয়ভাবে হারাম। আমাদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার নির্দেশনা এ বিষয়ে স্পষ্ট।” তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে ইরান নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা করছে।
তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান, পারমাণবিক আলোচনা পুনরায় শুরু করার জন্য। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি তাঁর আস্থা উল্লেখযোগ্য হারে কমে গিয়েছে, বিশেষ করে গত বছরের ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সাপোর্ট ও হামলার কারণে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল: মধ্যপ্রাচ্যে নতুন যুদ্ধের আশঙ্কা
ইরানের প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভূমিকাকে সমালোচনা করে বলেন, “মধ্যপ্রাচ্যে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, তা ট্রাম্প বা যুক্তরাষ্ট্রের নয়, এটি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর যুদ্ধ।” তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে বলেছেন, “এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যুক্ত না হওয়া ভালো, কারণ এটি তাদের যুদ্ধ নয়। এটা ইসরায়েলের আগ্রাসনের ফল।”
মার্কিন রাজনীতির এই সমালোচনায় উঠে এসেছে, মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘস্থায়ী অশান্তি ও সংঘাতের কারণ বিশ্লেষণ। ইরান বিশ্বাস করে, ইসরায়েল দীর্ঘমেয়াদী অস্থিরতা সৃষ্টি করছে এবং যুক্তরাষ্ট্র তা রোধে ব্যর্থ হয়েছে।
ইরান: আত্মনির্ভরশীল ও স্থিতিশীল রক্ষাকবচ
পেজেশকিয়ান সাক্ষাৎকারে আরও উল্লেখ করেন, ইরান রাশিয়া বা চীনের সামরিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল নয়। তিনি বলেন, “আমরা আল্লাহর ওপর বিশ্বাস করি এবং নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম।” এই আত্মনির্ভরতার কথা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে, কারণ ইরানের বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্ব ও ইসরায়েলের চাপ দিন দিন বাড়ছে।
মধ্যপ্রাচ্যের শান্তির জন্য প্রত্যাশা ও আহ্বান
পেজেশকিয়ান শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতি তার দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, “আমরা সবসময় শান্তির পক্ষে ছিলাম। আল্লাহ আমাদের অল্প সময় বাঁচতে দিয়েছেন এবং সেই সময় শান্তি ও সম্প্রীতিতে থাকা উচিত।” তার মতে, সংলাপ ও আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান সম্ভব।
তিনি ইরানের ঐতিহাসিক পটভূমি উল্লেখ করে বলেন, গত ২০০ বছরে ইরান কখনো কোনো আক্রমণ চালায়নি বরং যুদ্ধের শিকার হয়েছে, যেমন ইরাক যুদ্ধ এবং সাম্প্রতিক ইসরায়েল-ইরান সংঘাত।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প: শান্তির সম্ভাবনাকারী?
পেজেশকিয়ান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রতি আস্থা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্বে শান্তি ফেরানোর ক্ষমতা রয়েছে। তবে যদি তিনি ইসরায়েলকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন, তাহলে নতুন সংঘাত শুরু হবে, যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের পরিপন্থী।”
এমন সময়ে, যখন যুক্তরাষ্ট্র জুনের শেষ দিকে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়, ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। বিশেষ করে তার নিজের সমর্থকরা “চিরস্থায়ী যুদ্ধ” এর বিরোধিতা করছে।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের তথ্য পাওয়ার অধিকার
টাকার কার্লসন এই সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য সমালোচিত হলেও, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের সব তথ্য জানার অধিকার থাকার পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “আমরা তাদের কথাও শোনার অধিকার রাখি, যাদের সঙ্গে আমরা লড়াই করছি।”
ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের এই সাক্ষাৎকার মধ্যপ্রাচ্যের জটিল রাজনৈতিক ও সামরিক পরিস্থিতির গভীরতা তুলে ধরে। ইসরায়েলের সাথে উত্তেজনা, পারমাণবিক নীতি নিয়ে দ্বন্দ্ব, এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা—এসব বিষয় একত্রিত হয়ে নতুন বিতর্ক ও আলোচনার সৃষ্টি করেছে। বিশেষত, ইসরায়েল কর্তৃক হত্যাচেষ্টা ও বোমা হামলার অভিযোগ ইসরায়েল-ইরান সম্পর্কের কঠোরতা নির্দেশ করে।
ইরানের প্রেসিডেন্টের এই বক্তব্য মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যতের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি বুঝতে গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বশক্তিগুলো কি সত্যিই শান্তি প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী, নাকি তাদের নিজস্ব স্বার্থে আরও সংঘাত তৈরি হচ্ছে—এ প্রশ্ন এখনো বহাল।
আপনার মতামত ও আলোচনা জানাতে ভুলবেন না। সিংগনালবিডি ডটকমে আরও আপডেট পেতে আমাদের ফলো করুন।



