
দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা ঘটেছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা এবার থেকে দশম গ্রেডের বেতন স্কেলে বেতন-ভাতা পাবেন বলে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে। গত সোমবার (২৮ জুলাই) প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এই প্রজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়, যা দেশের প্রাথমিক শিক্ষা খাতে বড় ধরনের আর্থিক ও সামাজিক পরিবর্তনের দ্বার উন্মোচন করবে।
কেন গুরুত্বপূর্ণ এই সিদ্ধান্ত?
বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধান শিক্ষকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রধান শিক্ষকরা শুধু বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন না, তারা শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতেও কাজ করেন। দীর্ঘদিন ধরে প্রধান শিক্ষকদের বেতন-ভাতা এবং পদোন্নতির ক্ষেত্রে অনিয়ম ও অবহেলার অভিযোগ উঠেছে। তাদের আর্থিক নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির দাবিতে দীর্ঘদিন থেকে নানা মহল থেকে চাপ ছিল।
এখনো পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা ১১তম ও ১২তম গ্রেডের বেতন স্কেলে ছিলেন, যেখানে ১১তম গ্রেড ছিল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকদের জন্য এবং ১২তম গ্রেড ছিল প্রশিক্ষণবিহীন প্রধান শিক্ষকদের জন্য। কিন্তু জাতীয় উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় ৪৫ জন প্রধান শিক্ষকের বেতন দশম গ্রেডে উন্নীত হওয়ার পর, এটি সারাদেশের প্রধান শিক্ষকদের জন্য প্রযোজ্য করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে যা বলা হয়েছে
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ শিবলী সাদিকের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, “শিক্ষকরা জাতি গঠনের মূল কারিগর। তাদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।” বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, “সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের বেতন স্কেল দশম গ্রেডে উন্নীতকরণ যৌক্তিক বিবেচিত হওয়ায় সারাদেশে মোট ৬৫,৫০২ জন প্রধান শিক্ষকের বেতন স্কেল বিদ্যমান ১১তম ও ১২তম গ্রেড থেকে দশম গ্রেডে উন্নীতকরণে সরকার সম্মতি দিয়েছে।”
বেতন উন্নীতকরণের প্রভাব ও গুরুত্ব
এই পদক্ষেপের ফলে প্রধান শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে এবং তাদের সামাজিক মর্যাদা আরও সুসংহত হবে। এর ফলে তারা প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে আরও সৃজনশীল ও উদ্দীপ্ত ভূমিকা পালন করতে পারবেন। প্রধান শিক্ষকরা বিদ্যালয়ের পরিচালনাকে আরও দক্ষভাবে সামলাতে সক্ষম হবেন এবং শিক্ষার্থীদের জন্য একটি উন্নত ও গতিশীল শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন।
দেশের ৬৫ হাজারের বেশি প্রধান শিক্ষকের জন্য এক সুখবর
বাংলাদেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মোট সংখ্যা ৬৫,৫০২টি। এই বিদ্যালয়ের প্রতিটি প্রধান শিক্ষক এবার থেকে দশম গ্রেডের বেতন পাবেন। দীর্ঘদিন ধরে এই পরিবর্তনের জন্য প্রধান শিক্ষকদের অধীর আগ্রহ ছিল। এখন দেশের যেকোনো প্রান্তের প্রধান শিক্ষক আর্থিকভাবেও সুরক্ষিত বোধ করবেন। এটি প্রাথমিক শিক্ষকদের মধ্যে ন্যায়পরায়ণতার অনুভূতি জাগাবে এবং দেশের শিক্ষা খাতের উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত করবে।
সরকারের অঙ্গীকার ও শিক্ষা খাতের উন্নয়ন
সরকার শিক্ষকদের প্রতি দায়বদ্ধতা ও সম্মান প্রদর্শনে এই পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানা গেছে। সরকারের প্রত্যাশা, এই বেতন উন্নীতকরণ প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা অন্যান্য শিক্ষকমণ্ডলী, অভিভাবক ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সহযোগিতায় প্রাথমিক শিক্ষার মানকে কাঙ্ক্ষিত উচ্চতায় নিয়ে যাবেন।
প্রধান শিক্ষকদের দৃষ্টিভঙ্গি
বহু প্রধান শিক্ষক এই পদক্ষেপকে তাদের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন বলে অভিহিত করছেন। একজন প্রধান শিক্ষক মো. কামাল উদ্দিন বলেন, “এতদিন আমরা ন্যায্য সম্মান ও বেতন না পেয়ে হতাশায় ছিলাম। এই পদক্ষেপ আমাদের মনোবল বৃদ্ধি করবে এবং আমরা আরও উৎসাহ নিয়ে কাজ করতে পারব।”
অন্যদিকে শিক্ষাবিদরা বলছেন, “শিক্ষকদের আর্থিক উন্নয়ন হলে তারা শিক্ষার মানোন্নয়নে আরো সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারবেন। এটি শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক গুণগত মান বৃদ্ধি করবে।”
দেশের প্রাথমিক শিক্ষার বর্তমান চিত্র
বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষা হলো শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি। এখানে দেশের শিক্ষার্থীদের প্রথম শিক্ষা প্রদান করা হয়। প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা মানে দেশের মানব সম্পদ গড়ে তোলা। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ ও শিক্ষানীতির ফলে গত কয়েক বছরে প্রাথমিক শিক্ষার প্রবেশ হার বৃদ্ধি পেয়েছে, তবে মানোন্নয়ন এখনও চ্যালেঞ্জ।
এক্ষেত্রে প্রধান শিক্ষকদের সঠিক ভূমিকা, প্রশিক্ষণ ও আর্থিক প্রণোদনা শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই দিক থেকে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন স্কেল উন্নীতকরণ শিক্ষাক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হিসেবে ধরা হচ্ছে।
প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে আরও উদ্যোগের প্রয়োজন
শুধু বেতন বৃদ্ধি নয়, প্রাথমিক শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা আরও উন্নত করা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষাবিষয়ক উপকরণের আধুনিকায়ন, এবং পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ করাও গুরুত্বপূর্ণ। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এসব ক্ষেত্রেও কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের বেতন দশম গ্রেডে উন্নীত করার মাধ্যমে সরকার তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার মানোন্নয়নে নতুন অধ্যায় সূচিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। দেশের প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিজ দায়িত্ব পালনে আরও উৎসাহী ও শক্তিশালী হবেন, যা দেশের শিক্ষার সামগ্রিক উন্নয়নে বিরাট অবদান রাখবে।
MAH – 12002, Signalbd.com