বিশ্ব

হামাস গাজার ৮০% নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে: গাজার ভেতর নতুন শক্তির উত্থান

Advertisement

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস গাজার প্রায় ৮০ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে চলা ইসরায়েলি বিমান হামলা এবং স্থলবাহিনীর আক্রমণের কারণে গাজার নিরাপত্তা কাঠামো পুরোপুরি ধ্বংসপ্রাপ্ত। হামাসের ভেতরে বড় ধরণের ভাঙন ঘটেছে এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার শূন্যতা পূরণ করছে গাজার স্থানীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো। এক উচ্চপদস্থ হামাস নিরাপত্তা কর্মকর্তা এই তথ্য জানিয়েছেন।

গাজার নিরাপত্তা ব্যবস্থার ধস

হামাসের ওই শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তা ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর শুরু হওয়া ইসরায়েলি হামলার প্রথম সপ্তাহে গুরুতর আহত হন। আহত হওয়ার পর থেকে তিনি দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান। তবে বিবিসির কাছে তিনি ভয়েস মেসেজের মাধ্যমে গাজার বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন।

তিনি জানিয়েছেন, “কয়েক মাস ধরে চলা ইসরায়েলি বিমান হামলায় হামাসের নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। তাদের রাজনৈতিক, সামরিক ও নিরাপত্তা নেতৃত্ব ধ্বংসের মুখে।”

তিনি আরও বলেন, “নিরাপত্তা কাঠামোর প্রায় ৯৫ শতাংশ নেতৃবৃন্দ মারা গেছেন। গাজার অধিকাংশ এলাকা এখন হামাসের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। স্থানীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো এই শূন্যতা কাজে লাগিয়ে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করছে।”

হামাসের নেতৃত্বে চরম ভাঙন

গত সেপ্টেম্বর ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, ‘হামাসের সামরিক কাঠামো প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। তারা এখন গেরিলা যুদ্ধের মুখোমুখি।’

তবে চলতি বছরের শুরুতে ৫৭ দিনের যুদ্ধবিরতির সময় হামাস রাজনৈতিক ও সামরিক কাঠামো পুনর্গঠনের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু মার্চে ইসরায়েল সেই যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে হামাসের বাকি নেতৃত্বের ওপর আবারো আক্রমণ চালায়, যার ফলে হামাস আরও বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে যায়।

নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, “নিরাপত্তাব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। কোথাও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। মানুষ হামাসের সবচেয়ে শক্তিশালী নিরাপত্তা বাহিনীর অফিস লুট করেছে। এই অফিসটি ছিল গাজায় হামাসের শাসন পরিচালনার কেন্দ্র।”

গাজার নতুন সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর উত্থান

নিরাপত্তাব্যবস্থার শূন্যতা কাজে লাগিয়ে গাজার দক্ষিণাঞ্চলে ছয়টি নতুন সশস্ত্র গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। এরা স্থানীয় গোত্রভিত্তিক এবং বিভিন্ন ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত।

বিশেষ করে ইয়াসের আবু শাবাব নামে এক নেতা পশ্চিম তীরে হামাসের প্রতিদ্বন্দ্বী ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এবং অন্যান্য প্রভাবশালী গোষ্ঠীর নজর কাড়ছেন। ইসরায়েল তাঁকে অস্ত্র সরবরাহ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। হামাস তাঁকে হত্যা করার জন্য বড় অঙ্কের পুরস্কার ঘোষণা করেছে।

বিবিসিকে গাজার কিছু সূত্র জানিয়েছে, আবু শাবাব ও তার গোষ্ঠী একটি যৌথ পরিষদ গঠন করে হামাসকে গাজা থেকে উৎখাতের পরিকল্পনা করছে।

গাজায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিঃ সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর আধিপত্য

বর্তমানে গাজায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মারাত্মক অবনতির মুখে। সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো বিভিন্ন এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করেছে। এর ফলে ইসরায়েলি হামলার পাশাপাশি গাজার অভ্যন্তরীণ প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো হামাসের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই নিরাপত্তা শূন্যতার সুযোগ নিয়ে সশস্ত্র গ্যাং ও গোত্রভিত্তিক দলগুলোর তৎপরতা বেড়েছে। তারা গাজার জনগণের ওপর নিপীড়ন চালাচ্ছে, লুটপাট করছে এবং নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সহিংসতা চালাচ্ছে।

সাম্প্রতিক ইসরায়েলি হামলার প্রভাব

গত ২৬ জুন গাজার একটি বাজারে ইসরায়েলের ড্রোন হামলায় অন্তত ১৮ জন নিহত হন। ওই সময় হামাসের সাদা পোশাকধারী পুলিশ বাহিনী বাজারে অভিযান চালাচ্ছিলো, যারা দাম বাড়া ও ত্রাণ লুটের অভিযোগে তৎপর ছিল।

এই হামলা গাজার সাধারণ মানুষের জীবনকে আরও অসহনীয় করে তুলেছে এবং সংঘাতের জটিলতা বাড়িয়েছে।

গাজার ভবিষ্যৎ এবং যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, গাজার এই ভাঙাচোরা পরিস্থিতি দ্রুত আর কোনো ধরনের স্থিতিশীলতা ফিরে আসার সম্ভাবনা কমিয়ে দিয়েছে। সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো একে অপরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে, আর ইসরায়েলি আক্রমণ থামেনি।

তবে রাজনৈতিক পর্যায়ে কিছু আলোচনাও হচ্ছে, যেগুলো গাজার জন্য যুদ্ধবিরতির সুযোগ তৈরি করতে পারে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতে, “আগামী সপ্তাহেই গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি হতে পারে।”

যদিও মাঠ পর্যায়ে পরিস্থিতি এখনো অত্যন্ত তীব্র ও ঝুঁকিপূর্ণ।

গাজার জনজীবনে প্রভাব

গাজার প্রায় ২০ লাখ মানুষের জীবন এখন সঙ্কটে। বিদ্যুৎ, পানি, চিকিৎসা সেবা সবকিছুই মারাত্মক সংকটে পড়ে আছে। বেসামরিক লোকেরা যুদ্ধের অগ্নিগর্ভে পড়ে অনাহার, দুর্ভিক্ষ ও অসুস্থতার শিকার হচ্ছে।

গাজার হাসপাতালে চিকিৎসা সেবার অভাব এবং ইসরায়েলি বোমা হামলার কারণে অসংখ্য আহতের জীবন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো গাজার পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অনেক দেশ গাজার জন্য অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করার আহ্বান জানাচ্ছে।

তবে ইসরায়েল ও হামাস উভয়ের অবস্থান কঠোর থাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠা এখনো অনিশ্চিত।

গাজার নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখন সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। হামাস গাজার ৮০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে এবং নতুন সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো উঠে আসছে। গাজার সাধারণ মানুষ সংকটাপন্ন জীবনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক মহল থেকে যুদ্ধবিরতি ও শান্তি চুক্তির আহ্বান আসলেও মাঠ পর্যায়ে সংঘাতের অবসান এখনও দুরুহ।

এই পরিস্থিতিতে গাজার মানুষের দুর্দশা কমাতে বিশ্ব সম্প্রদায়কে দ্রুত কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button