
দক্ষিণ আমেরিকার প্রাণকেন্দ্র ব্রাজিলের পর্যটন নগরী রিও ডি জেনিরোতে শুরু হয়েছে ১৭তম ব্রিকস সম্মেলন ২০২৫। তবে এবার আলোচনার মূল কেন্দ্রে সদস্য দেশগুলোর অংশগ্রহণের চেয়ে অনেক বেশি জায়গা করে নিয়েছে দুই গুরুত্বপূর্ণ নেতা—রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং–এর অনুপস্থিতি।
শি জিনপিং কেন নেই?
২০১২ সালের পর এই প্রথমবারের মতো ব্রিকস সম্মেলনে সরাসরি অংশ নিচ্ছেন না চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। এবার তার প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নিচ্ছেন চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, শির অনুপস্থিতি শুধু কূটনৈতিক নয়, বরং চীনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও অর্থনৈতিক সংকটের প্রতিফলন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের অর্থনীতি মন্দার পথে, রিয়েল এস্টেট খাত সংকটে এবং যুব বেকারত্ব ২০% ছাড়িয়ে গেছে। এসব অভ্যন্তরীণ চাপে শি এখন অনেকটাই দেশের ভেতরের রাজনীতিতে মনোযোগী।
চীনের জন্য এটি ছিল কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন। কেননা ব্রিকস সম্প্রসারণের মাধ্যমে বেইজিং পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন জি-৭ ও ন্যাটোর বিকল্প একটি গ্লোবাল অ্যালায়েন্স দাঁড় করাতে চায়। শির অনুপস্থিতি তাই এই প্রয়াসে একটা মনস্তাত্ত্বিক ধাক্কা বলেই মনে করছেন অনেকে।
পুতিন অনুপস্থিত কেন?
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের অনুপস্থিতির পেছনে রয়েছে আন্তর্জাতিক আইনি জটিলতা। ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC) তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। ব্রাজিল রোম সংবিধির স্বাক্ষরকারী হওয়ায়, পুতিন এলে তাকে গ্রেফতার করার আইনি বাধ্যবাধকতায় পড়ত আয়োজক দেশ।
তবে পুতিন ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বক্তব্য রাখবেন বলে জানা গেছে। তার পরিবর্তে রাশিয়ার প্রতিনিধি হিসেবে সম্মেলনে উপস্থিত আছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ।
ব্রিকসের সম্প্রসারণ ও নতুন সদস্যরা
২০০৯ সালে গঠিত ব্রিকস (BRICS – Brazil, Russia, India, China, South Africa) ধীরে ধীরে একটি বিকল্প বৈশ্বিক জোটে রূপ নিচ্ছে। সম্প্রতি এই সংস্থার সদস্য সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১টি। নতুন সদস্যরা হল:
- ইরান
- ইথিওপিয়া
- ইন্দোনেশিয়া
- মিশর
- সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE)
এই সম্প্রসারণের ফলে ব্রিকস এখন দাবি করছে—বিশ্বের অর্ধেক জনসংখ্যা, ৩৬% ভূখণ্ড এবং ২৫% বৈশ্বিক জিডিপি-র প্রতিনিধিত্ব তারা করছে।
তবে বাস্তবতা হলো, এই বৃহৎ পরিসরে পরিচালনার ক্ষেত্রে সমন্বয় ও ঐকমত্য বজায় রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষত ভারতের সঙ্গে চীনের সীমান্ত বিরোধ এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা—এসব সংকট এই জোটের কার্যকারিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
আলোচনার মূল বিষয়: বাণিজ্য, জলবায়ু, এআই এবং যুদ্ধ
এ বছরের ব্রিকস সম্মেলনে আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হলো:
- বাণিজ্য ও বিনিয়োগে সহযোগিতা
- জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং টেকসই উন্নয়ন
- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) প্রযুক্তির ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ
- বিশ্ব স্বাস্থ্যনীতি এবং ভবিষ্যৎ মহামারী প্রস্তুতি
- গাজা সংকট ও ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা নিয়ে জোটের অবস্থান
মধ্যপ্রাচ্যে চলমান সংঘাত এবং ইসরায়েলের সামরিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নিতে চাইছে ইরান, দক্ষিণ আফ্রিকা ও মিশর। অন্যদিকে ভারত এবং ব্রাজিল তুলনামূলকভাবে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখছে। এই নীতিগত বৈচিত্র্য ব্রিকসের ভবিষ্যৎ ঐক্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।
ব্রিকস কি হতে পারবে জি-৭ এর বিকল্প?
ব্রিকসের সম্প্রসারণ, উন্নয়ন ব্যাংক গঠন, এবং একটি বিকল্প মুদ্রা চালুর আলোচনা দেখে অনেকেই বলছেন, এটি ধীরে ধীরে একটি “পূর্বমুখী বিশ্বব্যবস্থা” গঠনের পথ নিচ্ছে। তবে জি-৭ এর মতো সামরিক, কৌশলগত ও আর্থিক একতা ব্রিকসের নেই।
জি-৭ এর সদস্যদের মধ্যে রয়েছে শক্তিশালী সামরিক অ্যালায়েন্স (ন্যাটো) এবং একতাবদ্ধ অর্থনৈতিক নীতি। সেখানে ব্রিকস ভিন্ন সংস্কৃতি, রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক লক্ষ্য নিয়ে গঠিত।
বিশ্লেষকদের মতে, যতদিন না ব্রিকস অভ্যন্তরীণভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে পারছে, ততদিন এটি কেবল একটি আলোচনা প্ল্যাটফর্ম হিসেবেই রয়ে যাবে।
ভারত ও ব্রাজিলের নেতৃত্বে সম্মেলন
এই সম্মেলনে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একটি গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব প্রদান করছেন। তাঁরা বৈশ্বিক দক্ষিণের (Global South) পক্ষ থেকে উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে কার্যকর সমন্বয়ের আহ্বান জানিয়েছেন।
ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, “ব্রিকস হোক বিশ্ব উন্নয়নের নতুন পথনির্দেশক, যেখানে সমতা, সম্মান ও বাস্তবিক অংশীদারিত্ব থাকবে।”
ভবিষ্যৎ কী?
ব্রিকস ২০২৫ সম্মেলন একদিকে যেমন বৃহৎ ভূরাজনৈতিক সম্ভাবনার বার্তা দিচ্ছে, অন্যদিকে আবার নেতৃবৃন্দের অনুপস্থিতি ও মতানৈক্য ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেতও তুলে ধরছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি ব্রিকস সত্যিকার অর্থেই জি-৭ এর বিকল্প হতে চায়, তবে দরকার আরও বেশি কৌশলগত সংহতি, অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা এবং দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক কাঠামো।