ট্রাম্প কীভাবে ‘পাগল তত্ত্ব’ ব্যবহার করে বিশ্বকে বদলানোর চেষ্টা করছেন

প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাজনৈতিক কৌশল ও পররাষ্ট্রনীতির ধরন অনেকটাই অনিশ্চয়তা ও অপ্রত্যাশিত সিদ্ধান্তে পূর্ণ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় এই ধরনের আচরণকে বলা হয় ‘পাগল তত্ত্ব’ বা Madman Theory — একটি পুরনো কৌশল, যার মাধ্যমে শত্রুপক্ষকে বিভ্রান্ত করে চাপে ফেলার চেষ্টা করা হয়। এই তত্ত্বকে নিজস্বভাবে প্রয়োগ করে ট্রাম্প শুধু আমেরিকার অভ্যন্তরীন নীতিই নয়, বরং গোটা বিশ্ব রাজনীতির চেহারাও পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
কী এই ‘পাগল তত্ত্ব’?
‘পাগল তত্ত্ব’ হলো এমন এক কৌশল, যেখানে একজন নেতা নিজেকে অত্যন্ত অনিশ্চিত, অস্থির এবং অপ্রত্যাশিত সিদ্ধান্তগ্রহণকারী হিসেবে উপস্থাপন করেন। এতে শত্রুপক্ষ মনে করে, এই নেতা যে কোনো সময় উন্মাদ সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ফলে তারা নিজেরাই আলোচনার টেবিলে আসতে বাধ্য হয়।
১৯৬০ এর দশকে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন প্রথম এই তত্ত্বকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করেন ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়। তিনি হেনরি কিসিঞ্জারকে বলেছিলেন, “বলে দাও নিক্সন একজন পাগল। যদি তারা শান্তি না করে, তাহলে সে পারমাণবিক বোমা ফেলবে!” ট্রাম্প এই তত্ত্বকে আরও নাটকীয় এবং প্রচারমূলক রূপ দিয়েছেন।
ট্রাম্পের অনির্ভরযোগ্যতা: কৌশল নাকি স্বভাব?
ট্রাম্প প্রশাসনের সময় দেখা গেছে, তিনি প্রায়ই হঠাৎ করে নিজের সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেন। কখনো মিত্রদের আক্রমণ করেন, আবার পরক্ষণেই শত্রুকে আলিঙ্গন করেন। উদাহরণস্বরূপ, ইরান ইস্যুতে তিনি একদিকে যুদ্ধবিরতির কথা বলেন, আবার হঠাৎ করে বিমান হামলা চালান। এতে বিশ্বের রাজনীতিকরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন।
তার এমন খামখেয়ালি আচরণ রাজনীতিতে নতুন এক ঘরানার সৃষ্টি করে, যা পরবর্তীতে তার সমর্থকদের কাছে একধরনের কৌশলী চতুরতা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক: আক্রমণ, অপমান ও চুম্বন
ট্রাম্পের বৈদেশিক সম্পর্কের ধরন ছিল চরমভাবে দ্বিমুখী। একদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনকে আলিঙ্গন করেন, অন্যদিকে কানাডা, জার্মানি কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়নকে কটাক্ষ করেন। তিনি গ্রিনল্যান্ড দখলের কথা বলেন, নেটোর প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, এমনকি পানামা খালের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফেরত আনার ইচ্ছাও প্রকাশ করেন।
এইসব বক্তব্য একদিকে যেমন আমেরিকার পুরনো মিত্রদের মাঝে উদ্বেগ তৈরি করে, অন্যদিকে শত্রুদের মাঝে ভয়ের উদ্রেক করে — এবং সেটিই ছিল ট্রাম্পের উদ্দেশ্য।
ইউরোপ ও নেটোর ওপর চাপ সৃষ্টি
ট্রাম্প ইউরোপীয় দেশগুলোকে বারবার অভিযোগ করেছেন, তারা নেটোর প্রতিরক্ষা খাতে যথাযথভাবে অর্থ ব্যয় করছে না। তার এই চাপের ফলে ব্রিটেন তাদের প্রতিরক্ষা বাজেট জিডিপির ২.৩% থেকে বাড়িয়ে ২.৫% করেছে। এক নেটো সম্মেলনে এই হার ৫%-এ উন্নীত হয়।
এই ধরনের ফলাফল ট্রাম্প সমর্থকদের কাছে তাঁর কৌশলের সফলতা হিসেবেই ধরা পড়ে।
প্রতিপক্ষের ওপর কৌশলের প্রভাব: সবখানে কি কাজ করছে?
যদিও এই কৌশল ইউরোপীয় মিত্রদের ক্ষেত্রে সফলতা বয়ে এনেছে, তবে প্রতিপক্ষদের ক্ষেত্রে ফলাফল ছিল ভিন্ন। উদাহরণস্বরূপ, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন ট্রাম্পের হুমকি বা মোহ কোনোটিতেই কান দেননি। ইউক্রেনের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের অসংবেদনশীল আচরণও কূটনৈতিকভাবে সমালোচিত হয়েছে।
ইরানের ক্ষেত্রেও ট্রাম্প একদিকে চিরস্থায়ী যুদ্ধ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে আনার প্রতিশ্রুতি দেন, কিন্তু পরে হামলার সিদ্ধান্ত নেন। এতে করে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি আরও গোপন ও আগ্রাসী হয়ে ওঠে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
ট্রাম্পের ব্যবসায়ী মনোভাব ও দরকষাকষির কৌশল
ট্রাম্পের এই অনিশ্চয়তা-কেন্দ্রিক কৌশল তার ব্যবসায়ী জীবনের শিক্ষা থেকে আগত। আবাসন ব্যবসায় দীর্ঘদিন থাকার ফলে তিনি দরকষাকষির নানা পদ্ধতি আয়ত্ত করেন। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও তিনি সেটিই প্রয়োগ করেছেন। তিনি মনে করেন, অপ্রত্যাশিতভাবে আচরণ করলে প্রতিপক্ষ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সহজেই চুক্তি বা ছাড় দিতে রাজি হয়।
পাগল তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এই কৌশল দীর্ঘমেয়াদে টেকসই নয়। কারণ একবার যখন সবাই বুঝে ফেলে যে ট্রাম্প আসলে অনিশ্চয়তা দেখিয়ে তাদের উপর চাপ প্রয়োগ করতে চান, তখন এই কৌশলের কার্যকারিতা হ্রাস পায়। তাছাড়া, অতিরিক্ত অনিশ্চয়তা বিশ্ব রাজনীতিতে স্থিরতার পরিবর্তে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে।
নীতির চেয়ে কৌশল বেশি?
ট্রাম্পের রাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতিতে ‘নীতিগত ধারাবাহিকতা’র চেয়ে ‘কৌশলগত অনিশ্চয়তা’ই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। তিনি তার আচরণ দিয়ে বিশ্বের রাষ্ট্রনেতাদের বিভ্রান্ত করতে পেরেছেন ঠিকই, কিন্তু সেই বিভ্রান্তি সব সময় কাঙ্ক্ষিত ফল বয়ে আনেনি।
‘পাগল তত্ত্ব’ হয়তো একধরনের সাময়িক চাপ তৈরি করতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে আন্তর্জাতিক নীতিতে বিশ্বাসযোগ্যতা, সহযোগিতা ও স্থিতিশীলতাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
এম আর এম – ০২০২, Signalbd.com