বিশ্ব

ইসরায়েলি স্নাইপারদের গুলিতে রক্তাক্ত দুই ভাই, পাশে পড়ে ছিল পিৎজার বাক্স

পূর্ব জেরুজালেমে পারিবারিক এক আনন্দঘন সন্ধ্যায় আচমকা স্নাইপারদের গুলিতে আহত হয় দুই চাচাতো ভাই—একজন শিশু, অন্যজন তরুণ। দাদির হজ থেকে ফেরাকে কেন্দ্র করে জড়ো হয়েছিল পরিবার, কিন্তু মুহূর্তেই তা পরিণত হয় রক্তাক্ত বিভীষিকায়।

হঠাৎ শুরু হয় গুলি

পূর্ব জেরুজালেমের আত-তুর এলাকায় গত ১৬ জুন সন্ধ্যাবেলায় ঘটে যায় এক বিভীষিকাময় ঘটনা। আবু জুমা পরিবার সেই সময় তাদের দাদির হজ থেকে ফেরার আনন্দ উদযাপন করছিল। ১২ বছরের ইয়াস আবু মুফরেহ ও ২১ বছরের উদাই আবু জুমা—এই দুই চাচাতো ভাই বাড়ির সামনে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে বসে ছিলেন। সামনে ছিল পিৎজার বাক্স, সবার মুখে ছিল হাসি।

হঠাৎ করেই দূর থেকে গুলির শব্দ। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আনন্দপর্ব রূপ নেয় আতঙ্কে। দুজনের শরীর থেকে রক্ত ঝরছিল, পাশে পড়ে ছিল ছিন্নভিন্ন পিৎজার বাক্স।

গুলি ছিল ‘ডামডাম’, যা যুদ্ধেও নিষিদ্ধ

পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, গুলি ছোড়ার আগে কোনো ধরনের হুঁশিয়ারি সংকেতও দেওয়া হয়নি। নিরাপত্তা ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে, একটি দূরের ছাদ থেকে দুটি স্নাইপার একসঙ্গে গুলি ছোড়ে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আহতদের শরীরে যে গুলি পাওয়া গেছে তা ছিল ‘ডামডাম’ ধরনের—যা আন্তর্জাতিক আইনে নিষিদ্ধ এবং বিশেষভাবে প্রাণঘাতী।

ইয়াসের শরীরে গুলি লেগেছে কাঁধে, যা তার স্নায়ু এবং রক্তনালিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। গুলির অবস্থান হৃদপিণ্ড থেকে মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার দূরে ছিল। উদাইয়ের গুলিটি ঢুকে গিয়ে পিঠ দিয়ে বের হয়ে যায়, মেরুদণ্ড এবং অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

কোন পরিস্থিতিতে ঘটল এই হামলা?

এই হামলা সংঘটিত হয় এমন এক সময়ে, যখন ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে ১২ দিনের সংঘাত চলছিল। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ আত-তুরসহ পূর্ব জেরুজালেমের কয়েকটি এলাকাকে কৌশলগত কারণে ব্যারিকেড দিয়ে ঘিরে রেখেছিল।

পরিবারের দাবি, হামলার সময় আশপাশে কোনো সংঘর্ষ বা বিক্ষোভ চলছিল না। শিশুরা কেবল খাবার খাচ্ছিল—কোনো ধরনের “সন্ত্রাসী কার্যক্রম” বা হুমকি ছিল না।

গুলির পর পুলিশি হয়রানি

আহতদের দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করলে ইসরায়েলি পুলিশ অ্যাম্বুলেন্স থামিয়ে ইয়াসের বাবা রায়েদকে গ্রেপ্তার করে। তাদের অভিযোগ, ইয়াস ও উদাই মলোটভ ককটেল ছুড়েছে ও আতশবাজি জ্বালিয়েছে—যা পরিবার সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে।

চিকিৎসাকেন্দ্রেও পরিবারের সদস্যদের প্রবেশে বাধা দেয় পুলিশ। ইয়াসের মা নাসরিন বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলেন, “আপনারা একটা শিশুকে এভাবে গুলি করলেন কীভাবে?”

পুলিশের উত্তর ছিল, “আমরা জানি না কার গুলিতে আহত হয়েছে। হয়তো পারিবারিক দ্বন্দ্ব।” এমন জবাবে ক্ষোভে ফেটে পড়ে পরিবার।

আশঙ্কাজনক শারীরিক অবস্থা

বর্তমানে ইয়াস এবং উদাই দুজনই পশ্চিম জেরুজালেমের হাদাসা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ইয়াসের একাধিক অস্ত্রোপচার হয়েছে, এখনও তার বাঁ হাত পুরোপুরি অচল হয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। উদাই এখনো স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারেন না। চিকিৎসকদের মতে, তার পায়ের স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে স্থায়ীভাবে।

ইয়াসের বড় ভাই আমির আবু মুফরেহ বলেন, “আমার ভাই তো কোনো অপরাধী নয়। সে একটা ভালো ছেলে, মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে ভুট্টা বিক্রি করত।”

ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা

পরের দিন ঘটনাস্থলে হাজির হয় ইসরায়েলি পুলিশ। তারা দ্রুত রাস্তাঘাট থেকে গুলির খোসা, রক্ত, ভাঙা কাচ—সব কিছু পরিষ্কার করে দেয়। অবশিষ্ট ছিল শুধু গুলির এক চিহ্ন আর রক্তাক্ত পিৎজার বাক্স। পরিবার মনে করে, ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে পুলিশ এতো তড়িঘড়ি করে পরিষ্কার করেছে।

একজন প্রতিবেশী বলেন, “ওরা যেন এমনভাবে কাজ করল, যেন কিছুই ঘটেনি।”

আন্তর্জাতিক সমালোচনা ও মানবাধিকার প্রশ্ন

এ ধরনের ঘটনার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো প্রশ্ন তুলেছে। শিশুদের উপর এ ধরনের হিংস্র হামলা যুদ্ধাপরাধের শামিল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইসরায়েল পূর্ব জেরুজালেমে বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির কৌশল হিসেবেই এ ধরনের হামলা চালায়।

কবে থামবে এই সহিংসতা?

একটি শান্ত পারিবারিক সন্ধ্যা কীভাবে রক্তাক্ত ট্র্যাজেডিতে পরিণত হলো—এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে তা স্পষ্ট। একজন শিশু হয়তো চিরদিনের মতো স্বাভাবিক জীবন হারাতে যাচ্ছে, আরেকজন হয়তো আর কখনো হাঁটবে না।

প্রশ্ন থেকে যায়: নিরীহ শিশুদের ওপর গুলি চালানো কি কোনোভাবেই বৈধতা পেতে পারে? আন্তর্জাতিক সমাজ কি আরও সোচ্চার হবে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে?

এম আর এম – ০১৯৩, Signalbd.com

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button