বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট সমাধানে নতুন বৈশ্বিক উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আগামী চার মাসের মধ্যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। এই উদ্যোগে অংশীদার হিসেবে থাকছে জাতিসংঘ, কাতার এবং বাংলাদেশ। মূল লক্ষ্য হলো বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিল বাড়ানো এবং তাদের মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ফিরিয়ে নেওয়া।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, আট বছর পর এই সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ ফেরানোর জন্য এক জোরালো প্রচেষ্টা শুরু করা হয়েছে।
কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক সম্মেলন
রোহিঙ্গা ঢলের আট বছর পূর্তির দিন ২৫ আগস্ট কক্সবাজারে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে, যার শিরোনাম ‘অংশীজন সংলাপ: রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে উচ্চপর্যায়ের আলোচনার জন্য প্রাপ্ত বার্তা’। এই সম্মেলনে উপস্থিত থাকবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এছাড়া কয়েকটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, রোহিঙ্গাবিষয়ক আন্তর্জাতিক দূত, বাংলাদেশ দূতাবাস এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা অংশ নেবেন।
কক্সবাজারের শিবিরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরাও সম্মেলনে অংশগ্রহণ করবেন।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন জানিয়েছেন, কক্সবাজারে আলোচনায় আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে অন্তত ১০টির বেশি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা অংশ নেবেন। সৌদি আরব, কাতার, চীন, তুরস্ক, ফিনল্যান্ড, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, গাম্বিয়া প্রভৃতির প্রতিনিধিত্ব থাকবে।
সম্মেলনের দিনসূচি
কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত সম্মেলন তিনদিনব্যাপী হবে।
- ২৪ আগস্ট: আলোচনা শুরু এবং প্রস্তুতি অধিবেশন।
- ২৫ আগস্ট: প্রধান অধিবেশন, যেখানে রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা এবং রাখাইনে প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনার আয়োজন।
- ২৬ আগস্ট: অতিথিরা রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করবেন এবং শরণার্থীদের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করবেন।
মহড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও এই তিনদিনের প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে থাকবে।
রোহিঙ্গা সংকটের পটভূমি
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর নিধনযজ্ঞ চালানোর পর লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। আট বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও সমস্যা সমাধানে তৎপরতা সীমিত ছিল। বৈশ্বিক রাজনৈতিক এবং সামরিক সংঘাতের কারণে আন্তর্জাতিক মনোযোগ কমেছে।
- ২০২০ সালে করোনা মহামারী
- ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ
- ২০২৪ সালে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত
এসব ঘটনার কারণে রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা ধারাবাহিকভাবে কমেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ১৪ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে।
রাখাইন রাজ্য আরাকান আর্মির দখলে চলে যাওয়ায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ফলে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা তাদের নিজ আবাসে ফিরে যাওয়ার আশা হারিয়ে ফেলেছেন।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও সহযোগিতা
কক্সবাজারের সম্মেলনের মাধ্যমে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পুনরায় রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে যুক্ত করতে চাচ্ছে।
শরণার্থীদের জন্য তহবিল সংগ্রহ এবং রাজনৈতিক সমর্থন বৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়ে সরকার মধ্যপ্রাচ্য ও আসিয়ানের দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছে।
নিউইয়র্কে ৩০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হবে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ফাঁকে রোহিঙ্গাবিষয়ক উচ্চপর্যায়ের সম্মেলন। এ সম্মেলনের অবস্থানপত্র কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত সংলাপের ভিত্তিতে প্রণয়ন করা হবে।
এরপর ৬ ডিসেম্বর কাতারের দোহায় রোহিঙ্গাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। এতে কক্সবাজার ও নিউইয়র্কের আলোচনার ফলাফল বিশ্লেষণ ও প্রাসঙ্গিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও রোহিঙ্গাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেছেন, কক্সবাজারের আন্তর্জাতিক সংলাপ নিউইয়র্ক এবং দোহা সম্মেলনের জন্য একটি প্রস্তুতি ভূমিকা পালন করবে।
কৌশলগত লক্ষ্য
কক্সবাজার সম্মেলনের মূল লক্ষ্য হলো:
- মানবিক সহায়তা বৃদ্ধি – খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
- প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া শুরু – রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্যে নিরাপদভাবে ফিরিয়ে নেওয়া।
- আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব জোরদার করা – রাজনৈতিক ও আর্থিক সমর্থন সংগ্রহ করা।
- সংস্কৃতি ও সচেতনতা বৃদ্ধি – রোহিঙ্গাদের সংস্কৃতি এবং বাস্তবিক চ্যালেঞ্জ বিশ্বকে জানানো।
এই উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশ চায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পুনরায় রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সক্রিয় করতে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কক্সবাজার সম্মেলনের ফলাফল রোহিঙ্গা সংকটের জন্য দূরদর্শী সমাধানের দিকে এক নতুন পথ খুলতে পারে।
- আন্তর্জাতিক তহবিল বৃদ্ধি পাবে।
- রোহিঙ্গাদের মানসিক ও সামাজিক পুনর্বাসনের সুযোগ তৈরি হবে।
- মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে বাস্তবসম্মত ও নিরাপদ করা সম্ভব।
বাংলাদেশের সরকার এবং জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থাগুলো আশা করছে, এই উদ্যোগ রোহিঙ্গা সংকটের দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের সূচনা করবে।
MAH – 12315 , Signalbd.com



