নিরাপত্তাহীনতায় গাজার ত্রাণ কেন্দ্রে ৭০০’রও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত।

গাজার দীর্ঘমেয়াদী অবরোধ ও তীব্র খাদ্য সংকটে বিপর্যস্ত ফিলিস্তিনিরা ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে খাবার নিতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে। আল জাজিরা ও স্থানীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে জানা গেছে, কমপক্ষে ৭৪৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৪৮৯১ জন আহত হয়েছেন। এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক মহলে নতুন করে নিন্দা ও ক্ষোভ জেগেছে।
গাজায় ত্রাণ নিতে গিয়ে প্রাণহানির ভয়াবহতা
গাজার অবরুদ্ধ এলাকার শত শত ক্ষুধার্ত মানুষ ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে খাবার ও অন্যান্য সাহায্য সংগ্রহ করতে গিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় পড়েছেন। বিশেষ করে, গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ)-এর কেন্দ্রগুলোতে এই হতাহতের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে। জিএইচএফ ২০২৫ সালের মে মাসের শেষে গাজায় কার্যক্রম শুরু করলেও, বিতর্ক ও সমালোচনার মুখে পড়েছে কারণ তাদের কেন্দ্রগুলোতে ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলিবর্ষণ এবং স্টান গ্রেনেড ছোড়ার অভিযোগ উঠেছে।
আল জাজিরার গাজার প্রতিবেদক হানি মাহমুদ বলেন, “এই নিহত ও আহতের সংখ্যা অত্যন্ত রক্ষণশীল। বাস্তবে অনেক বেশি হতাহতের আশঙ্কা রয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “গাজার দীর্ঘমেয়াদী অবরোধ এবং খাদ্য সংকটের কারণে মানুষ এখন বাঁচার তাগিদে ত্রাণ কেন্দ্রে আসছে, যেখানে নিরাপত্তাহীনতার কারণে প্রাণ হারাচ্ছে।”
গাজার খাদ্য সংকট ও মানবিক বিপর্যয়
ইসরায়েলের অবরোধ ও সামরিক অভিযানের কারণে গাজার প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষ ক্রমাগত খাদ্য ও পানীয় জলের তীব্র অভাবের সম্মুখীন। অনেক পরিবার একেবারেই খাদ্য সংকটে রয়েছে, যেখানে মায়েরা নিজেদের খাওয়া বাদ দিয়ে সন্তানদের বাঁচাতে চেষ্টা করছেন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সূত্রের বরাতে জানা যায়, শিশু ও বয়স্করা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।
গাজার এক বাসিন্দা বলেন, “আমরা খেতে পাচ্ছি না। ত্রাণ না পেলে কিভাবে বাঁচব? কিন্তু ত্রাণ নিতে এসে গুলি খেলেও যদি বাঁচি, তবুও চেষ্টা করতে হবে।”
বিতর্কিত ত্রাণ সংগঠন জিএইচএফ
জিএইচএফ’র কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকে তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। একাধিক প্রতিবেদন দাবি করেছে, জিএইচএফ’র ঠিকাদার এবং ইসরায়েলি সেনারা সাহায্য প্রার্থীদের ওপর গুলি চালিয়েছে। মার্কিন ঠিকাদারদের বরাতে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস জানিয়েছে, এই গুলিতে বেসামরিকরা লক্ষ্যবস্তু হয়েছে।
তবে জিএইচএফ তাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা’ বলেছে এবং দাবি করেছে তারা তাদের কর্মীদের ও সহায়তাপ্রাপ্তদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছে।
মার্কিন সরকারের সমর্থন ও ত্রাণ বিতরণ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই সংস্থার কার্যক্রমকে সমর্থন জানিয়ে এসেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন ২০২৫ সালের জুন মাসে জিএইচএফ-কে ৩০ মিলিয়ন ডলার সরাসরি অর্থায়ন দিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, “জিএইচএফ হল একমাত্র সংস্থা যারা গাজায় খাদ্য ও মানবিক সাহায্য পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে।”
তবে গত শনিবার, খান ইউনিসের একটি বিতরণ কেন্দ্রে গ্রেনেড হামলায় দুই মার্কিন কর্মী আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। হামলার দায়িত্ব এখনও স্পষ্ট নয়। জিএইচএফ জানিয়েছে, আহতদের চিকিৎসা চলছে এবং তাদের অবস্থা স্থিতিশীল।
মানবাধিকার সংস্থার তীব্র সমালোচনা
বিশ্বের প্রধান মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই সংস্থার কার্যক্রমের তীব্র সমালোচনা করেছে। তারা বলেছে, জিএইচএফ ২০ লক্ষ মানুষের মধ্যে অতিরিক্ত ভিড় সৃষ্টি করছে, যেখানে নিরাপত্তার অভাব ও সশস্ত্র সংঘর্ষের ঝুঁকি বাড়ছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই প্রকল্পকে ‘অমানবিক ও প্রাণঘাতী সশস্ত্র পরিকল্পনা’ হিসেবে অভিহিত করেছে এবং অবিলম্বে এর কার্যক্রম বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে।
গাজার ভবিষ্যত ও আন্তর্জাতিক দায়িত্ব
গাজা এখন মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি। খাদ্যের অভাব, চিকিৎসার সংকট এবং নিরাপত্তাহীনতা সেখানে প্রতিদিনের দুর্বিষহ বাস্তবতা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে, দ্রুত এবং কার্যকর উদ্যোগ নিয়ে গাজার মানুষদের বাঁচানোর ব্যবস্থা করতে হবে। অবরোধ উঠানো, শান্তি আলোচনা শুরু করা এবং মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখা সবচেয়ে জরুরি।
বিশ্বের প্রধান প্রধান রাষ্ট্র ও সংস্থাগুলোকে গাজার এই সংকট মোকাবেলায় আরও বৃহত্তর দায়িত্বশীলতা ও মানবিক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। গাজার হাজার হাজার নিরীহ মানুষ মাত্র ত্রাণ নিতে গিয়ে প্রাণ হারানো বন্ধ করতে হবে।