বিশ্ব

ইরানের সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিত, আইএইএর পরিদর্শকরা ইরান ছাড়লেন

আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) ও ইরানের সম্পর্ক: পারমাণবিক ইস্যুতে নতুন সংকট

৫ জুলাই ২০২৫, ভিয়েনা, তেহরান থেকে প্রতিবেদন – আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ)-এর একদল পরিদর্শক ইরান ছেড়ে ফিরে গেছেন। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের চলমান সাম্প্রতিক সংঘাতের প্রেক্ষিতে তেহরান সরকার আইএইএর সঙ্গে সকল ধরনের সহযোগিতা স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা নিরাপত্তাজনিত কারণে ইরান ত্যাগ করেছেন।

আইএইএর পরিদর্শকরা কেন ইরান ছাড়লেন?

আইএইএর পক্ষ থেকে শুক্রবার এক বিবৃতিতে জানানো হয়, পরিদর্শক দল অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় সংস্থার সদর দপ্তরে ফিরে গেছেন। এ বিষয়ে আইএইএর মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি বলেছেন, “ইরানের সঙ্গে দ্রুত আলোচনার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ ও যাচাই কার্যক্রম পুনরায় শুরু করা খুবই জরুরি।” তবে ইরান এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে স্থির প্রতিক্রিয়া দেয়নি।

তেহরানের আল–জাজিরা সংবাদদাতা রেসুল সেরদারের বরাত দিয়ে জানা গেছে, পুরো দল না হলেও বেশ কয়েকজন পরিদর্শক ইতোমধ্যে ইরান ছেড়েছেন এবং তারা আর্মেনিয়ার মাধ্যমে নিরাপদে দেশে ফিরে গেছেন। তবে ইরানে এখনও কিছু কর্মী অবস্থান করছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ইরান ও আইএইএ সম্পর্কের নতুন অধ্যায়: পারমাণবিক অনিশ্চয়তার যুগ

তেহরান থেকে প্রকাশিত বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এই ঘটনা ইরানে পারমাণবিক ইস্যুতে এক নতুন ‘অনিশ্চয়তার যুগ’ শুরু করেছে। গত কয়েক মাস ধরে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে বিরাজমান উত্তেজনার প্রেক্ষিতে পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা ও পরিচালনা নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

ইরান পারমাণবিক কর্মসূচির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন মেনে চলার বিষয়ে আইএইএর পর্যবেক্ষকরা তৎপর ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সংঘাত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোমাবর্ষণের পর পরিস্থিতি একেবারে বদলে গেছে।

ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পেছনের প্রেক্ষাপট

১৩ জুন ২০২৫ তারিখে ইসরায়েল ইরানের সামরিক স্থাপনায় হামলা চালায়, যার ফলে ইরানের কয়েকজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা এবং গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক বিজ্ঞানী নিহত হন। এই হামলার জেরে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা ব্যাপক মাত্রায় বৃদ্ধি পায়।

এরপর যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের পক্ষে সামরিকভাবে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে এবং ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর বোমা বর্ষণ চালায়। মার্কিন প্রশাসনের দাবি, এই অভিযান ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে লক্ষণীয়ভাবে পিছিয়ে দিয়েছে।

ইরানের কঠোর প্রতিক্রিয়া: আইএইএর ওপর আস্থা হারানো

যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের বিমান হামলার পর ইরান ঘোষণা দেয়, তারা এখন আর আইএইএ-এর ওপর ভরসা করতে পারছে না। তেহরান জানিয়েছে, যদিও তারা পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক এনপিটি চুক্তির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, কিন্তু আইএইএর সঙ্গে সহযোগিতা এখন থেকে স্থগিত থাকবে।

ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান গত বুধবার আইএইএর সঙ্গে সকল সহযোগিতা বন্ধের নির্দেশ দেন। এটি ইরানের পার্লামেন্ট ও সর্বোচ্চ গার্ডিয়ান কাউন্সিলের অনুমোদনের পর কার্যকর করা হয়। গার্ডিয়ান কাউন্সিলের মুখপাত্র হাদি তাহান নাজিফ বলেন, “এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে ইরানের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষার গুরুত্ব রয়েছে।”

আন্তর্জাতিক সমাজের প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

বিশ্বজুড়ে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ও পরমাণু নিরাপত্তা বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা ইরানের এই সিদ্ধান্তকে গভীর উদ্বেগের সঙ্গে দেখছেন। আইএইএর সঙ্গে সহযোগিতা বন্ধ থাকায় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির স্বচ্ছতা কমে যাবে, যা আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য নতুন ঝুঁকি তৈরি করবে।

অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, ইরান-ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার চলমান উত্তেজনা কূটনৈতিক সমাধানের পরিবর্তে সামরিক সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দিতে পারে। অন্যদিকে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া ও চীনসহ অন্যান্য শক্তিধর দেশ গুলো এই পরিস্থিতির শিথিলতা আনার জন্য মধ্যস্থতা করার চেষ্টা চালাচ্ছে।

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ও আইএইএর ভূমিকা

আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) এর প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ করা এবং পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করা। ১৯৭০ সালের এনপিটি (পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার প্রতিরোধ চুক্তি) অনুযায়ী, ইরান সহ সকল স্বাক্ষরকারী দেশকে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি আইএইএর তত্ত্বাবধানে রাখতে হয়।

ইরান বহু বছর ধরেই সন্দেহের মুখে রয়েছে যে তারা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে। যদিও ইরান সবসময় দাবি করেছে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য।

তবে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক উত্তেজনা, সামরিক হামলা ও আইএইএর কঠোর তদন্তের কারণে ইরানের সঙ্গে সহযোগিতা থেমে যাওয়ায় এই বিষয়টি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।

ইরান ও আইএইএ-এর মধ্যে সহযোগিতা বন্ধ এবং আইএইএর পরিদর্শকদের দেশ ত্যাগ, পারমাণবিক ইস্যুতে একটি নতুন সংকটের সূচনা করেছে। এই সংকট আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। ভবিষ্যতে কূটনৈতিক উদ্যোগ ও আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button