নরেন্দ্র মোদির তৃতীয় মেয়াদে ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে হেইট ক্রাইম বৃদ্ধি

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বছরেই দেশজুড়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক অপরাধ এবং বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রোটেকশন অফ সিভিল রাইটস (এপিসিআর) কর্তৃক প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
হেইট ক্রাইমের ভয়াবহ বাস্তবতা
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৭ জুন ২০২৪ থেকে ৭ জুন ২০২৫ পর্যন্ত সময়কালে ভারতে মোট ৯৪৭টি হেইট ক্রাইমের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য (হেইট স্পিচ) ৩৪৫টি এবং সরাসরি হিংসাত্মক অপরাধ ৬০২টি। হিংসাত্মক অপরাধের মধ্যে ১৭৩টি ঘটনায় শারীরিক আঘাত এবং ২৫টি ঘটনায় মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ নিহত হয়েছেন।
বিশেষভাবে উদ্বেগজনক হচ্ছে, নিহতরা সবাই মুসলিম সংখ্যালঘু। এই তথ্য ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার প্রতি গভীর প্রশ্ন তোলে।
সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সংগঠিত সহিংসতা
প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, এই সহিংসতা শুধু ইচ্ছাকৃত নয়, বরং ‘পদ্ধতিগত ও প্রতিহিংসাপরায়ণ’ ধাঁচের। মুসলিম, দলিত, আদিবাসী ও খ্রিস্টানসহ নানা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর এ ধরনের সহিংসতা সরকারি নীরবতা ও রাজনৈতিক প্ররোচনার কারণে বাড়ছে।
রাজনৈতিক নেতাদের বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্যের সংখ্যা উদ্বেগজনক
৩৪৫টি বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্যের মধ্যে ১৭৮টি বিজেপি ও তার সমর্থিত ব্যক্তিবর্গের। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজেও ৫টি, বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রীরা ৬৩টি এবং অন্যান্য নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা ৭১টি বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। তালিকায় দুজন বিচারক এবং একজন রাজ্য গভর্নরও রয়েছেন।
বিজেপি-শাসিত রাজ্যে হেইট ক্রাইমের শীর্ষস্থান
বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রে ঘৃণা-সম্পর্কিত অপরাধের সংখ্যা বেশি। এই রাজ্যগুলোর হিন্দু উৎসব যেমন গণেশ চতুর্থী, নবরাত্রি, রাম নবমী ও হোলি, পরিকল্পিতভাবে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার পরিসর হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। মিডিয়া, রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর ও পুলিশের অবহেলা এই সহিংসতাকে আরো উস্কে দিচ্ছে।
পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা ও দায়মুক্তি
৬০২টি হেইট ক্রাইমের মধ্যে মাত্র ১৩ শতাংশ ঘটনায় এফআইআর দায়ের হয়েছে, যা পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা ও কিছু ক্ষেত্রে জড়িত থাকার ইঙ্গিত দেয়। এর ফলে অপরাধীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং হিংসার প্রবণতা বাড়ছে।
নির্বাচনী প্রেক্ষাপটে হেইট ক্রাইম
এই প্রতিবেদন বলছে, স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনগুলো হেইট ক্রাইম ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের জন্য সুযোগ তৈরি করছে। বিশেষ করে দিল্লি, ঝাড়খণ্ড, মহারাষ্ট্র এবং উত্তরাখণ্ডে নির্বাচনের সময় হেইট ক্রাইমের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বিজেপির রাজনৈতিক স্বার্থে সংঘটিত হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
হিন্দুত্ববাদ: মতাদর্শ থেকে শাসন কাঠামোয়
এপিসিআর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বর্তমান ভারতে হিন্দুত্ববাদ আর শুধুমাত্র একটি মতাদর্শ নয়; এটি একটি শাসন কাঠামোতে পরিণত হয়েছে। যেখানে সংখ্যালঘুদের উপর সহিংসতা স্বাভাবিকীকরণ করা হচ্ছে এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সুরক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
গুজরাটের ২০০২ সালের স্মৃতি
২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার স্মৃতি এখনও তাজা। ওই সময় হিন্দু সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর হাতে হাজার হাজার মুসলিম নিহত হয়েছিলেন। সেই ভয়াবহ পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি যেন আজকের হেইট ক্রাইম পরিস্থিতিতে ধরা পড়ছে।
ভারতের সংখ্যালঘু পরিস্থিতির বর্তমান অবস্থা
ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হেইট ক্রাইম ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের এই ভয়াবহ বৃদ্ধি দেশের সাংবিধানিক মূল্যবোধ ও সামাজিক সমতার জন্য গুরুতর হুমকি। ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সংখ্যালঘু অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রের ভূমিকা প্রাধান্য পেতে হবে। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক স্বার্থ ও সাম্প্রদায়িক ভাবাবেগের কারণে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা সংকটে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই পরিস্থিতি বন্ধ করতে হলে সরকারের সুনির্দিষ্ট নীতি ও দ্রুত পদক্ষেপ প্রয়োজন। পুলিশ ও বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও দ্রুত কার্যকরী ভূমিকা না নিলে, হেইট ক্রাইমের প্রবণতা বাড়তেই থাকবে।
কী করা উচিত?
১. দ্রুত ও কার্যকর আইন প্রয়োগ: ঘৃণা-সম্পর্কিত অপরাধের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
২. পুলিশ ও প্রশাসনের দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি: যারা দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
৩. সাংস্কৃতিক সহনশীলতা ও সংখ্যালঘু অধিকার রক্ষা: শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শুরু করে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
৪. রাজনৈতিক নেতাদের দায়িত্বশীলতা: বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য থেকে বিরত থাকতে হবে এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।
ভারতের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও সাংবিধানিক অধিকার রক্ষায় এখনই সময় সক্রিয় পদক্ষেপ নেওয়ার। মোদির তৃতীয় মেয়াদের শুরুতেই হেইট ক্রাইমের এই ভয়াবহ বৃদ্ধি দেশের সামাজিক সংহতি ও উন্নয়নের জন্য বিপদজনক সংকেত। সংখ্যালঘুদের প্রতি সহিংসতা রোধে সরকার, প্রশাসন ও সমাজের সকল স্তরের সচেতনতা ও ঐক্য প্রয়োজন।