ইসরায়েল নয়, যুদ্ধের পর ইরানের পাশেই থাকছে সৌদি আরব

সৌদি আরবের কৌশল বদল: ইসরায়েলের পরিবর্তে ইরানের সাথে আরও ঘনিষ্ঠতা
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান যুদ্ধের প্রেক্ষিতে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ও কূটনীতি যেন নতুন মোড় নিচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েল ও আরব দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের দিকে নজর ছিল, কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো সৌদি আরবকে ইরানের দিকে আরও বেশি ঝুঁকতে বাধ্য করেছে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানের সামরিক পদক্ষেপ শুরু হওয়ার পর থেকে সৌদি আরব তেহরানের সঙ্গেই সম্পর্ক গড়ার প্রচেষ্টা বাড়িয়েছে। এটি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ভারসাম্য ও ভবিষ্যত কূটনীতি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলছে।
নেতানিয়াহুর স্বপ্ন এবং বাস্তবতা
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বহুবার উল্লেখ করেছেন, তিনি সৌদি আরবসহ আরব দেশগুলোর সঙ্গে শান্তিচুক্তি করতে চান। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামাসের আকস্মিক হামলার আগে, ইসরায়েল-সৌদি সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ব্যাপারটি খুবই কাছাকাছি ছিল। কিন্তু এই যুদ্ধ এবং গাজার ধ্বংসযজ্ঞ সেই সম্ভাবনাকে থামিয়ে দিয়েছে।
নেতানিয়াহু নিজেই স্বীকার করেছেন, ‘সৌদি আরব ও অন্যদের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করব কীভাবে, সেটা আমাকেই দেখতে দিন।’ তবে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে এটা স্পষ্ট যে, সৌদি আরব যুদ্ধের পর তেহরানের সাথেই সম্পর্ক দৃঢ় করতে চাইছে, যা ইসরায়েলের জন্য কঠিন ধাক্কা।
সৌদি আরবের পরিবর্তিত অবস্থান: গাজা যুদ্ধ ও ইরানের প্রভাব
গাজার ইসরায়েলি হামলার সময় সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান কড়া সমালোচনা করেছেন। তিনি ইসরায়েলের কার্যক্রমকে ‘গণহত্যা’ বলে উল্লেখ করেছেন। এর ফলে সৌদি আরবের যুবসমাজের মধ্যে ইসরায়েলের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব বেড়েছে, যা ক্রাউন প্রিন্সের অর্থনৈতিক সংস্কারের পরিকল্পনার জন্য সমস্যার সৃষ্টি করেছে।
ইরানের সঙ্গে সৌদি আরবের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উন্নতির দিকে গেছে। ২০১৯ সালের পারস্য উপসাগরে জ্বালানি স্থাপনায় হামলার পর তেহরান-রিয়াদ দ্বন্দ্ব তীব্র হলেও, ২০২৩ সালের মার্চে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন হয়। এখন মোহাম্মদ বিন সালমান ও ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান নিয়মিত ফোন যোগাযোগ রাখছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা কী বলছেন?
বাহরাইনের আন্তর্জাতিক ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের বিশ্লেষক হাসান আল-হাসান জানান, ‘ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ফলে সৌদি আরবের ভাবমর্যাদা ও আঞ্চলিক নেতৃত্বের অবস্থানে ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে। কারণ ফিলিস্তিনি ইস্যু সৌদি রাজনীতির একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয়।’
ওয়াশিংটনের মধ্যপ্রাচ্য ইনস্টিটিউটের গবেষক গ্রেগরি গাউস বলেন, ‘২০২৫ সালের ইরান আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী এবং আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার কারণ হয়ে উঠেছে। ইসরায়েলের সামরিক পদক্ষেপ এই অস্থিতিশীলতাকে আরও বাড়িয়েছে।’
আব্রাহাম অ্যাকর্ডস এবং সৌদি আরবের অপেক্ষা
২০২০ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’ নামে পরিচিত একটি ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পাদন করেছিল। সৌদি আরব যদি এতে যোগ দেয়, তা হবে মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক সমীকরণের একটি বিরাট পরিবর্তন।
তবে ৭ অক্টোবরের যুদ্ধের পর এই চুক্তিতে সৌদি আরবের যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই সংকুচিত হয়েছে। যুবরাজ স্পষ্ট জানিয়েছে, ফিলিস্তিনিদের জন্য রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অগ্রগতি ছাড়া ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি কঠিন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার সফরে একাধিকবার সৌদি আরবের এই যোগদানের ইঙ্গিত দিয়েছেন, কিন্তু বাস্তবিক পরিস্থিতি ভিন্ন।
ভবিষ্যত কূটনীতি ও অর্থনৈতিক বিনিয়োগ
ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফরের সময় উপসাগরীয় দেশগুলো বহু ট্রিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর মাধ্যমে তারা যুক্তরাষ্ট্রের উন্নত প্রযুক্তি ও নিরাপত্তা সহযোগিতার সুবিধা পেতে চায়। কিন্তু যুদ্ধের উত্তাপের মধ্যেও সৌদি আরব এবং ইরানের মধ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রিন্স খালিদ বিন সালমান ইরানি সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে ফোনালাপ করেছেন, যেখানে তারা ‘নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ’ নিয়ে আলোচনা করেছেন।
ইসরায়েলের জন্য অপেক্ষাকৃত সহজ পথ: নিরাপত্তা চুক্তি
বিশ্লেষকরা মনে করেন, সৌদি আরবের মতো বড় দেশের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের বদলে নিরাপত্তা সংক্রান্ত সীমিত সহযোগিতা শুরু করা সম্ভব। এটি ইসরায়েলের জন্য দ্রুত ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ হতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যের জটিল কূটনীতি
ইসরায়েল ও ইরানের চলমান সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক মানচিত্রে বিশাল প্রভাব ফেলেছে। সৌদি আরব যুদ্ধের পর থেকে ইরানের পাশে বেশি ঝুঁকেছে, যা ঐতিহাসিকভাবে তাদের অবস্থানের একটি বড় পরিবর্তন। ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের স্বপ্ন এখন বিলুপ্তির পথে, তবে অর্থনৈতিক বিনিয়োগ ও নিরাপত্তা সহযোগিতার মাধ্যমেই হয়তো নতুন পথ তৈরি হবে।
সৌদি আরবের পরবর্তী পদক্ষেপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির গতি বিশ্ব রাজনীতির দৃষ্টি আকর্ষণ করবে বলে মনে করা হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে Signalbd.com নিয়মিত তথ্য ও বিশ্লেষণ নিয়ে থাকবে আপনাদের পাশে।