মুসলিমদের উপর অত্যাচার বাড়ছে মোদীর ভারতে

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির তৃতীয় মেয়াদে মাত্র এক বছরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ভয়াবহ হেট ক্রাইম বা ঘৃণা অপরাধের ঘটনা বেড়েছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু মুসলিম ও খ্রিস্টান ছাড়াও দলিত, আদিবাসী ও অন্যান্য পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের ওপর এই সহিংসতার মাত্রা উদ্বেগজনক।
মানবাধিকার রক্ষা সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রটেকশন অফ সিভিল রাইটস (এপিসিআর) এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদন এ ভয়ঙ্কর চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে। ২০২৪ সালের জুন থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত সময়কালে ৯৪৭টি ঘৃণা অপরাধের তথ্য উঠে এসেছে, যা দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার একটি দৃষ্টান্ত।
মোদির তৃতীয় মেয়াদে ঘৃণা অপরাধের পরিসংখ্যান
- মোট ঘৃণা অপরাধ: ৯৪৭টি
- ঘৃণা ভাষণ: ৩৪৫টি
- ঘৃণা অপরাধ (ফিজিক্যাল অ্যাটাক, ভাঙচুর, হত্যাকাণ্ড): ৬০২টি
- শারীরিক হামলায় নিহত সংখ্যালঘু: ২৫ জন (সকলেই মুসলিম)
- আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু: ২৫ জন (তাদের বেশিরভাগই ঘটনাস্থলে থাকা বনে আঘাতপ্রাপ্ত)
এই পরিসংখ্যান স্পষ্টভাবে দেখায় যে, সংখ্যালঘুদের উপর প্রভাবিত হওয়া হিংসা এবং রাজনৈতিক সহিংসতার মাত্রা অস্বাভাবিক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে।
ঘৃণা অপরাধের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
এপিসিআরের প্রতিবেদন উল্লেখ করে, এই অপরাধ ও হিংসাত্মক বক্তব্যের পেছনে রাজনৈতিক, সাংগঠনিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক উৎসাহ ও মদদ রয়েছে। বিশেষ করে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে ঘৃণা অপরাধ ও ভাষণ সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে।
৩৪৫টি ঘৃণা ভাষণের মধ্যে ১৭৮টি ভাষণ বিজেপি ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাদের দেওয়া। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজেও এই এক বছরে ৫টি ঘৃণা ভাষণ দিয়েছেন। বিজেপি সরকারের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য মন্ত্রীরা মোট ৬৩টি ভাষণ দিয়েছেন এবং অন্যান্য নির্বাচিত নেতারা ৭১টি ভাষণ প্রদান করেছেন।
এছাড়া, অদ্ভুত হলেও সত্য, দুইজন বিচারপতি এবং একজন রাজ্যপালও ঘৃণা ভাষণ দিয়েছেন, যা ভারতের বিচার বিভাগ ও প্রশাসনে গভীর উদ্বেগের কারণ।
সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নির্যাতন ও সামাজিক অবস্থা
উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, রাজস্থান, বিহার, গুজরাট ও হরিয়ানা সহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ব্যাপক হামলার ঘটনা ঘটেছে। শুধু উত্তরপ্রদেশেই এক বছরে ২১৭টি অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ঘৃণা অপরাধের ধরন হলো বাড়িঘর ভাঙচুর, জবরদখল, শারীরিক নির্যাতন, হত্যাকাণ্ড এবং সামাজিক বঞ্চনা। সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি বুলডোজার দিয়ে ধ্বংস, স্কুল ও হাসপাতাল আক্রমণসহ নানা ধরনের সহিংসতার তথ্য রয়েছে।
মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুরে এক খ্রিস্টান পাদরি থানায় সাহায্য চাইলেও বজরং দলের নেতাদের হাতে নির্যাতিত হওয়ার ঘটনাও উঠে এসেছে।
সংখ্যালঘুদের জন্য আইনি সুরক্ষা এবং বাস্তবতা
২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এপিসিআর প্রতিবেদন উল্লেখ করে, সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণা অপরাধের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক রেকর্ড বা পর্যাপ্ত আইনি ব্যবস্থার অভাব রয়েছে। দলিত ও উপজাতিদের জন্য ১৯৮৯ সালের তফসিল জাতি ও উপজাতি (অত্যাচার নিরোধ) আইন থাকলেও সংখ্যালঘুদের জন্য এখনও সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তাও উদ্বেগের কারণ। ৬০২টি ঘৃণা অপরাধের মধ্যে মাত্র ১৩% ক্ষেত্রে এফআইআর (আরম্ভিক অভিযোগ) হয়েছে, যা পুলিশের পক্ষ থেকে কার্যকর পদক্ষেপের অভাবের প্রতিফলন।
ঘৃণা ভাষণ এবং তার সামাজিক প্রভাব
জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী, ঘৃণা অপরাধ হল এমন অপরাধ যেখানে কারো সামাজিক পরিচয়ের ভিত্তিতে তাকে আক্রান্ত করা হয়। ঘৃণা ভাষণ হিংসা ও বিভাজন বাড়ায়, যা সামাজিক শান্তি নষ্ট করে এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করে।
এপিসিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক নির্বাচন ও স্থানীয় ভোটে ঘৃণা ভাষণ বাড়ে। ২০২৪-২৫ সালে নির্বাচনী সময় রাজ্যগুলিতে এ ধরনের বক্তব্য এবং সহিংসতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন
২০২৪ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মোদি ও তার দল মূলত নির্বাচনী প্রচারনায় ঘৃণা ভাষণ ব্যবহার করে থাকেন। প্রান্তিক ও সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বৈষম্য ও শত্রুতা উস্কে দিয়ে নির্বাচন জেতার চেষ্টা করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী মোদি নিজে ১১০টি নির্বাচনী ভাষণে ইসলামবিরোধী বক্তব্য প্রদান করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়।
ধর্মীয় উৎসব ও সামাজিক উত্তেজনা
ঘৃণা অপরাধ ছড়ানোর জন্য বিভিন্ন হিন্দু ধর্মীয় উৎসব যেমন গণেশ চতুর্থী, নবরাত্রি, রাম নবমী ও দোল উৎসবকে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই উৎসবগুলোকে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়ানোর মঞ্চ হিসেবে পরিণত করা হয়েছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ রয়েছে।
সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা
- গুজরাটে প্রায় দুই হাজার মুসলিম পরিবারের বসতবাড়ি ‘বাংলাদেশি’ অভিযোগের ভিত্তিতে ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
- মধ্যপ্রদেশে খ্রিস্টান পাদরিকে পুলিশের কাছে সাহায্যের বদলে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে।
- উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন জেলায় সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
ভারতের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে দেখা যাচ্ছে, হিন্দুত্ববাদ কেবল একটি মতাদর্শ নয়, এটি এখন রাষ্ট্র শাসনের কাঠামো হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে সংখ্যালঘু, দলিত ও আদিবাসী সম্প্রদায় এক ভয়াবহ হুমকির মুখে রয়েছে।
এপিসিআরের প্রতিবেদন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, দেশের সংবিধান ও মানবাধিকারের মৌলিক নীতিগুলো সুরক্ষিত রাখতে হলে রাজনৈতিক নেতৃত্বের স্বচ্ছতা ও আইনি সংস্কারের বিকল্প নেই।