বিশ্ব

নীল নদে ইথিওপিয়ার জলবিদ্যুৎ বাঁধ

আফ্রিকার বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ‘গ্র্যান্ড রেনেসাঁ ড্যাম’ (GERD) নির্মাণ সম্পন্ন, উদ্বোধনের অপেক্ষায়

ইথিওপিয়ার নীল নদে নির্মিত গ্র্যান্ড রেনেসাঁ বাঁধ (Grand Ethiopian Renaissance Dam – GERD) আফ্রিকার বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ২০১১ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পটির নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার, যা ইথিওপিয়ার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে বাঁধটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করার পরিকল্পনা রয়েছে।

এই বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে ইথিওপিয়া শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াবে না, পাশাপাশি দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে এই প্রকল্পের কারণে নীল নদ ভাটির অন্য দুটি দেশ মিসর ও সুদান তাদের জলস্রোত সংরক্ষণ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

গ্র্যান্ড রেনেসাঁ বাঁধ: প্রকল্পের বিস্তারিত ও গুরুত্ব

গ্র্যান্ড রেনেসাঁ বাঁধ ইথিওপিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে, নীল নদ তীরে অবস্থিত। এই বাঁধের দৈর্ঘ্য প্রায় এক কিলোমিটার এবং উচ্চতা প্রায় ৪৭৫ ফুট। বাঁধের পানি ধারণক্ষমতা ৭,৪০০ কোটি কিউবিক মিটার, যা বিশাল এক জলাধার সৃষ্টি করেছে।

বাঁধ থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ক্ষমতা ৫ হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি, যা ইথিওপিয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদনের বর্তমান সক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ। এই বিদ্যুৎ দেশের গ্রামীণ ও শহুরে অঞ্চল জুড়ে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে সহায়ক হবে, যেখানে এখনো ব্যাপক অংশ বিদ্যুৎহীন।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ইথিওপিয়ার প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা এখনও বিদ্যুৎ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। সেই দিক থেকে এই বাঁধ দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

নীল নদ ভাটির দ্বন্দ্ব: ইথিওপিয়া, মিসর ও সুদানের জটিলতা

নীল নদ তিনটি প্রধান দেশ – ইথিওপিয়া, সুদান ও মিসরের জন্য প্রাণবায়ু সরবরাহের উৎস। বিশেষত মিসরের ক্ষেত্রে, নীল নদ থেকে আসে দেশটির মোট পানির ৯৭ শতাংশ, যা দেশের কৃষি, মানব জীবন ও শিল্পকৌশলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ইথিওপিয়ার গ্র্যান্ড রেনেসাঁ বাঁধ নির্মাণকে মিসর ও সুদান উদ্বেগের চোখে দেখে। তারা আশঙ্কা করছেন, এই বিশাল বাঁধের কারণে তাদের দেশে নীল নদ থেকে পানির প্রবাহ কমে যাবে, যা তাদের জীবিকা ও পানি নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করতে পারে।

২০১১ থেকে চলমান এই প্রকল্প নিয়ে নিয়মিত আলোচনা এবং সমঝোতার চেষ্টা থাকলেও, এখন পর্যন্ত মিসর ও সুদানের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত সমঝোতা হয়নি। চলতি বছরই মিসর এবং সুদানের শীর্ষ নেতারা বৈঠকে বসে নীল নদ অববাহিকা সংক্রান্ত যে কোনো একতরফা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নিয়েছেন।

ইথিওপিয়ার বার্তা: হুমকি নয়, সুযোগ

ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ এই বাঁধের বিরুদ্ধে থাকা আপত্তি ও সমালোচনা মোকাবেলায় বলেন, “এই বাঁধ হুমকি নয়, বরং সবার জন্য সুযোগ। এটি শুধুমাত্র ইথিওপিয়ার নয়, বরং নীল নদ ভাটির সব দেশের জন্য উন্নয়নের পথ খুলে দেবে।”

তিনি আরও যোগ করেন, “আমরা মিসর ও সুদানকে বলছি, এটি আপনারা যদি শত্রুতা না দেখে যৌথ উন্নয়নের সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেন, তাহলে আমরা সবাই উপকৃত হব।”

অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব

ইথিওপিয়ায় বিদ্যুতের অভাব দীর্ঘদিনের সমস্যা। বিদ্যুৎ সুবিধার উন্নয়ন ও উৎপাদনের জন্য গ্র্যান্ড রেনেসাঁ বাঁধ একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই প্রকল্প দেশের অর্থনৈতিক বিকাশকে ত্বরান্বিত করবে, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং আধুনিক শিল্পায়নের সুযোগ বাড়াবে।

বাঁধ নির্মাণের ফলে পর্যটন শিল্পেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশাবাদী বিশেষজ্ঞরা। বিশাল জলাধার ও এর চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেশটিতে পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে।

জলবায়ু পরিবর্তন ও জলসাশ্রয়

বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে পানি সঞ্চয় এবং জল সম্পদ ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। গ্র্যান্ড রেনেসাঁ বাঁধের মাধ্যমে ইথিওপিয়া জল সঞ্চয় ও নিয়ন্ত্রণের দিক থেকে আরও সক্ষম হয়ে উঠবে। এটি কেবল বিদ্যুৎ উৎপাদন নয়, বরং বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং কৃষিক্ষেত্রেও উপকারী ভূমিকা পালন করবে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও চ্যালেঞ্জ

যদিও বাঁধটি উদ্বোধনের অপেক্ষায়, তবে নীল নদ ভাটির দেশগুলোর মধ্যে জলসম্পদ নিয়ে সমঝোতা করা এখনো চ্যালেঞ্জ। মিসর ও সুদানের নিরাপত্তা উদ্বেগ মোকাবেলা করতে পারলে এই প্রকল্পের সুফল নিলে পুরো অঞ্চলের উন্নয়ন সম্ভব।

আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা ও সমঝোতা ছাড়া এই সংকট সমাধান কঠিন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। জল সম্পদের ন্যায্য বণ্টন ও সুসম্পর্ক বজায় রাখতে ভবিষ্যতে আরও উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

গ্র্যান্ড রেনেসাঁ জলবিদ্যুৎ বাঁধ শুধুমাত্র ইথিওপিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতীক নয়, বরং আফ্রিকার শক্তি ও সম্ভাবনার প্রতিফলন। তবে এই প্রকল্প সফল ও টেকসই হতে হলে নীল নদ ভাটির সকল দেশের মধ্যে সহযোগিতা ও শান্তিপূর্ণ আলোচনা অপরিহার্য।

ইথিওপিয়া, মিসর এবং সুদান যদি মিলিতভাবে এই প্রকল্পকে গ্রহণ করে, তাহলে আফ্রিকার জন্য এটি শুধু একটি বাঁধ নয়, বরং বিকাশ ও শান্তির সেতুবন্ধন হতে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button