জাতিসংঘের দাবি: ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ করুন

বিশ্বের দৃষ্টি ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতে: জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞ ফ্রানচেসকা আলবানিজের জরুরি বার্তা
জাতিসংঘের অধীনে অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড বিষয়ক বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার ফ্রানচেসকা আলবানিজ সম্প্রতি এক কঠোর ও স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন: ইসরায়েলের সঙ্গে সকল ধরণের বাণিজ্যিক ও আর্থিক সম্পর্ক অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। তার এই আহ্বান বিশ্বের সকল রাষ্ট্র ও সংস্থার প্রতি, যারা মানবাধিকার ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেয়।
জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে আলবানিজের চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদন
২০২৫ সালের ৩১শে জুলাই, জেনেভায় অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের সভায় ফ্রানচেসকা আলবানিজ একটি নতুন প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। যেখানে তিনি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন, অবৈধ উপনিবেশ গঠন এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ করেছেন। এই প্রতিষ্ঠানগুলো ইসরায়েলের অবৈধ দখলদারিত্বকে অর্থনৈতিকভাবে সমর্থন করে আসছে, যা ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর গণহত্যার “অর্থনীতি” সৃষ্টি করেছে।
‘গণহত্যার অর্থনীতি’: করপোরেট স্বার্থ ও মানবতার ধ্বংস
আলবানিজের ভাষ্য, “ইসরায়েলের আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম নিষ্ঠুর গণহত্যা” চালিয়ে যাওয়ার পেছনে বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থনৈতিক স্বার্থ কাজ করছে। তার এই প্রতিবেদনটি শিরোনামকৃত হয়েছে — ‘ফ্রম ইকোনমি অব অকুপেশন টু ইকোনমি অব জেনোসাইড’ — অর্থাৎ দখলদারির অর্থনীতি থেকে গণহত্যার অর্থনীতি।
তিনি জানান, ইসরায়েলি কোম্পানি এবং আন্তর্জাতিক বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে অবৈধ বসতি সম্প্রসারণে সরাসরি অর্থায়ন, নজরদারি প্রযুক্তি, অস্ত্র সরবরাহ ও অন্যান্য সেবা দিয়ে সহায়তা করছে। এসব সংস্থা এই সংঘাত থেকে কোটি কোটি ডলারের মুনাফা অর্জন করছে, যেখানে ফিলিস্তিনি সাধারণ মানুষ হত্যা, উচ্ছেদ ও ধ্বংসের শিকার।
গাজা: মানবিক বিপর্যয়ের প্রকট চিত্র
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এই উপত্যকায় প্রায় ৫৭ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, এবং কয়েক লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। শহর ও গ্রামগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, হাসপাতাল, স্কুল, এবং বেসামরিক অবকাঠামোও নিয়মিত হামলার শিকার হচ্ছে।
জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী, গাজার ৮৫ শতাংশ এলাকা এখন ইসরায়েলের সামরিক নিয়ন্ত্রণে, যা এক অবরুদ্ধ অঞ্চলে গণহত্যার ছবি তুলে ধরে। এই মানবিক বিপর্যয়ের পেছনে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো নিরব ভূমিকা পালন করছে, এমনটাই মনে করছেন আলবানিজ।
ইসরায়েলের সামরিক-শিল্প খাত ও অস্ত্রের অমানবিক ব্যবহার
ফ্রানচেসকা আলবানিজের প্রতিবেদন বলছে, ইসরায়েলের সামরিক-শিল্প খাতই দেশটির অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করছে। তেল আবিব স্টক এক্সচেঞ্জে গাজা যুদ্ধে হামলার পর ২১ মাসে ২০০ শতাংশেরও বেশি দর বৃদ্ধি পেয়েছে, যার বাজার মূল্য প্রায় ২২ হাজার কোটি ডলার। অর্থাৎ, ইসরায়েল যুদ্ধে যত বেশি হত্যা করছে, তাদের সামরিক খাত তত বেশি মুনাফা করছে।
বিশেষজ্ঞ আলবানিজ জানান, ইসরায়েলের অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো আধুনিক ও শক্তিশালী যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ করছে, যা গাজায় এক পর্যায়ে ৮৫ হাজার টন বিস্ফোরক ফেলার ক্ষমতা প্রদর্শন করেছে—যা হিরোশিমার পারমাণবিক বোমার চেয়ে ছয় গুণ বেশি শক্তিশালী।
আন্তর্জাতিক করপোরেটদের জবাবদিহিতার আহ্বান
আলবানিজ জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানিয়েছেন, তারা যেন এসব করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি যারা ফিলিস্তিনি মানুষের ওপর সহিংসতা ও অবৈধ দখলদারি সমর্থন করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘনকারী এসব প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্বশীল করতে হবে।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক নেতারা গাজায় রক্তপাত থামাতে যখন ব্যর্থ হচ্ছেন, তখন অনেক বড় বড় করপোরেট সংস্থা ইসরায়েলের বর্ণবাদ, অবৈধ দখলদারি এবং গণহত্যার সঙ্গে জড়িয়ে নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থ পূরণ করছে।
বিশ্বকে কী করতে হবে?
ফ্রানচেসকা আলবানিজের পরামর্শ একদম স্পষ্ট:
- ইসরায়েলের সঙ্গে সমস্ত ধরনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থগিত করুন,
- আন্তর্জাতিক সাহায্য ও অর্থায়ন বন্ধ করুন,
- ইসরায়েলের ওপর পূর্ণ অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করুন,
- যেসব প্রতিষ্ঠান মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা ও ভবিষ্যত ভাবনা
বিশ্ব আজ এই সংকটময় পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আছে। মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক আইন ও ন্যায়বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত অবিলম্বে সক্রিয় ভূমিকা নেওয়া। অন্যথায়, ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর চলমান নিপীড়ন ও গণহত্যার হিড়িক থামানো যাবে না।
বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলো ইতোমধ্যেই ইসরায়েলবিরোধী কঠোর পদক্ষেপের দাবিতে মুখ খুলেছে। অনেক দেশেও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের আন্দোলন শুরু হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞের আহ্বান যথাযথ সময়ে এসেছে।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত আজ শুধু একটি ভূ-রাজনৈতিক সমস্যা নয়, এটি একটি বিশাল মানবিক বিপর্যয় এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘন। ফ্রানচেসকা আলবানিজের প্রতিবেদন ও আহ্বান বিশ্ববাসীকে স্মরণ করিয়ে দেয়, শান্তি, ন্যায় ও মানবতার পক্ষে দাঁড়ানো আমাদের সবার দায়িত্ব।
বিশ্বকে এখন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে: অবৈধ দখলদারির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া না হলে, আরো অগণিত প্রাণ হারাবে, শত শত শিশুর ভবিষ্যত অন্ধকারে ঢাকা পড়বে।