‘গাজায় হিরোশিমার চেয়ে ৬ গুণ শক্তিশালী বোমা ফেলেছে ইসরায়েল’

গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি হামলার মাত্রা বেড়ে চলেছে। জাতিসংঘের ফিলিস্তিন বিশেষ দূত ফ্রান্সেসকা আলবানিজ গাজায় নিক্ষিপ্ত বিস্ফোরকের পরিমাণকে হিরোশিমা পারমাণবিক বোমার ছয় গুণ শক্তিশালী বলে উল্লেখ করেছেন।
বৃহস্পতিবার ৩ জুলাই জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে ফিলিস্তিনের সাম্প্রতিক অবস্থা উপস্থাপন করতে গিয়ে তিনি বলেন, গাজায় ৮৫ হাজার টন বিস্ফোরক নিক্ষেপ করা হয়েছে যা ইতিহাসের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক এবং নিষ্ঠুর গণহত্যার অংশ।
গাজায় ব্যবহৃত বিস্ফোরকের পরিমাণ ও শক্তি
ফ্রান্সেসকা আলবানিজের ভাষ্যমতে, গাজায় ইসরায়েলের হামলায় ব্যবহৃত বিস্ফোরক শক্তি হিরোশিমার পারমাণবিক বোমার ছয় গুণের বেশি।
“৮৫ হাজার টন বিস্ফোরক নিক্ষেপ করা হয়েছে, যা গাজা উপত্যকাকে ধ্বংসের মুখে ফেলেছে,” তিনি জাতিসংঘে বলেন।
এই বিস্ফোরকের ফলে গাজার জনসাধারণের জীবন ও বসতি স্থায়ীভাবে বিপন্ন হয়েছে।
ইসরায়েলি অস্ত্র কোম্পানির রেকর্ড মুনাফা
জাতিসংঘের বিশেষ দূত আরও উল্লেখ করেন, এই বিস্ফোরক ব্যবহারের পেছনে ইসরায়েলকে আধুনিক ও অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে সজ্জিত করেছে অস্ত্র প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো, যারা এতে বিশাল রেকর্ড মুনাফা অর্জন করেছে।
বিশ্বব্যাপী অস্ত্রবাণিজ্যের এই অন্ধকার দিকটি গাজার ক্ষতিকে আরও গভীর করেছে।
ফিলিস্তিনে মানবাধিকার পরিস্থিতির নিন্দা
ফ্রান্সেসকা আলবানিজ বলেন, গাজায় যে ‘গণহত্যা’ ঘটছে তা আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম নিষ্ঠুর ঘটনা।
তিনি মার্কিন ও ইসরায়েল কর্তৃক পরিচালিত তথাকথিত “গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন”-কে ‘একটি মৃত্যুফাঁদ’ বলে অভিহিত করেন, যা ক্ষুধার্ত, দুর্বল ও নিঃস্ব জনগোষ্ঠীকে হত্যা অথবা পালিয়ে যেতে বাধ্য করার জন্য নির্মিত হয়েছে।
হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি
জাতিসংঘ বিশেষ দূত ফিলিস্তিনে সরকারি ও স্বাধীন উৎস থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যানে উল্লেখ করেন, গাজায় ২ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি হতাহত হয়েছে।
তবে স্বতন্ত্র স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মত অনুযায়ী, প্রকৃত মৃতের সংখ্যা সরকারি তথ্যের চেয়ে অনেক বেশি হতে পারে।
সাম্প্রতিক তথ্য: গাজায় নিহত ও আহতের সংখ্যা
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ১১৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৫৮১ জন আহত হয়েছে।
এই হতাহতদের মধ্যে ১২ জন ত্রাণপ্রার্থীও রয়েছেন, যারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সমর্থিত একটি ত্রাণকেন্দ্রে যাওয়ার সময় হামলার শিকার হয়েছেন।
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে সামগ্রিক হতাহতের সংখ্যা
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ইসরায়েলি হামলায় কমপক্ষে ৫৭,১৩০ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ১,৩৪,৫৯২ জন আহত হয়েছেন।
এই তথ্য থেকে বোঝা যায়, গাজায় মানবিক সংকট ও সংঘাতের মাত্রা কতটা বাড়ছে।
গাজায় বোমা বর্ষণের নৃশংসতা: আন্তর্জাতিক উদ্বেগ
বিশ্বব্যাপী অনেক দেশ ও মানবাধিকার সংস্থা গাজায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ এবং বেসামরিক জনগণের উপর হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।
জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো বারবার আহ্বান জানিয়েছে, সংঘাতের অবসান এবং মানবিক সাহায্যের অবাধ প্রবেশ নিশ্চিত করতে।
তবুও ইসরায়েলের সামরিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে, যার ফলে সাধারণ মানুষের দুর্দশা বেড়ে চলেছে।
ইসরায়েলের পক্ষ: সুরক্ষা দাবি ও বিরোধী মত
অন্যদিকে, ইসরায়েল তার এই সামরিক অভিযানকে নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবাদ রোধের জন্য জরুরি বলে দাবি করে। তারা বলেন, হামলাগুলো রকেট আক্রমণ ও হামাস সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা।
তবে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গাজায় গৃহীত এই কঠোর পদক্ষেপ অসামরিকদের উপর অযাচিত বর্বরতা ও গণহত্যার শামিল।
গাজা সংকটের ইতিহাস: কী কারণে আজকের এই পরিস্থিতি?
গাজা উপত্যকা দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন সংঘাতের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র।
১৯৪৮ সালের ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকার ও জমি নিয়ে নানা ধরনের সংঘাত চলেছে।
গত দুই দশকে গাজায় হামাসের শাসন ও ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে এই সংঘাত তীব্রতর হয়েছে।
প্রতিনিয়ত ইসরায়েলি বোমাবর্ষণ এবং প্রতিক্রিয়ায় হামাসের রকেট আক্রমণ ঘটে আসছে।
আন্তর্জাতিক সংস্থার আহ্বান ও সমাধানের পথ
জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা বারবার সংঘাত বন্ধ করে শান্তি আলোচনার আহ্বান জানিয়েছে।
মানবিক সাহায্য দ্রুত গাজায় পৌঁছানোর জন্যও তারা চাপ দিচ্ছে।
বিশ্ব সম্প্রদায়ের সহযোগিতা ছাড়া গাজায় স্থায়ী শান্তি ও পুনর্গঠন সম্ভব নয়।
গাজার মাটিতে চলছে মানবিক বিপর্যয়
গাজায় ইসরায়েলি হামলার তীব্রতা, বিস্ফোরকের পরিমাণ, এবং হতাহতের সংখ্যা বিশ্ববাসীর জন্য বড় এক সতর্কবার্তা।
হিরোশিমার চেয়ে ছয় গুণ শক্তিশালী বিস্ফোরক ব্যবহারে গাজায় তৈরি হচ্ছে এক মানবিক বিপর্যয়, যা সাম্প্রতিক ইতিহাসে নজিরবিহীন।
এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য শান্তি প্রক্রিয়া, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও মানবিক সাহায্য অতীব জরুরি।