বিশ্ব

রাশিয়া তালেবানকে স্বীকৃতি দিল — নতুন ভূরাজনীতির অধ্যায়

রাশিয়া বিশ্বে প্রথম দেশ হিসেবে আফগানিস্তানের তালেবান সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই ঘোষণা কেবল দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার রাজনীতিতেই নয়, বরং বৈশ্বিক কূটনৈতিক অঙ্গনেও গভীর আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতির মাধ্যমে এই ঘোষণা দেয়, যা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এপি-তেও গুরুত্বের সাথে প্রকাশিত হয়েছে।

রাশিয়ার এই পদক্ষেপ বৈশ্বিক কূটনীতি, সন্ত্রাসবাদ বিরোধী নীতি, আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং ইউরো-এশিয়ান জিওপলিটিকসকে নতুন দিকনির্দেশনা দিচ্ছে।

ক্রেমলিনের আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক স্বীকৃতি

মস্কোতে নিযুক্ত তালেবান সরকারের রাষ্ট্রদূত সম্প্রতি ক্রেমলিনে তার পরিচয়পত্র পেশ করেন। এটি একটি দ্যুরূদ্ধর্ম কূটনৈতিক আনুষ্ঠানিকতা যা স্বীকৃত রাষ্ট্র ও সরকারগুলোর মধ্যেই সম্পাদিত হয়ে থাকে। ফলে এটি কেবলমাত্র একটি প্রতীকী পদক্ষেপ নয়—বরং রাশিয়ার পক্ষ থেকে তালেবান সরকারকে সার্বভৌম রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে মেনে নেওয়ার প্রকাশ্য ঘোষণা।

রাশিয়ার সুপ্রিম কোর্ট ২০২৪ সালের এপ্রিলে তালেবান সংগঠনটির ওপর থেকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে আরোপিত স্ট্যাটাস প্রত্যাহার করে নেয়, যা এই স্বীকৃতির প্রাক্-প্রস্তুতির অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।

রাশিয়ার স্বার্থ ও ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

রাশিয়ার এই কৌশলগত সিদ্ধান্তের পেছনে রয়েছে বহুমাত্রিক কারণ:

১. আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণ

তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তানের মতো মধ্য এশিয়ার প্রাক্তন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোর সাথে তালেবান-শাসিত আফগানিস্তানের সীমান্ত রয়েছে। এই অঞ্চলগুলিতে ইসলামি চরমপন্থার বিস্তার রাশিয়ার জন্য দীর্ঘমেয়াদে হুমকি। তালেবান সরকারের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন রাশিয়ার জন্য নিরাপত্তা এবং গোয়েন্দা আদান-প্রদানের পথ সুগম করতে পারে।

২. অর্থনৈতিক স্বার্থ ও খনিজ সম্পদে প্রবেশাধিকার

আফগানিস্তান বিপুল পরিমাণ দুর্লভ খনিজ সম্পদের আধার—বিশেষ করে লিথিয়াম, তামা, কোলটান ইত্যাদি, যা রাশিয়ার প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখে রাশিয়া বিকল্প খনিজ উৎস ও বাণিজ্য অংশীদার খুঁজছে।

৩. পশ্চিমা প্রভাবের বিরোধিতা

রাশিয়া এবং পশ্চিমা বিশ্ব—বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যকার ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ক্রমাগত তীব্র হচ্ছে। তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে রাশিয়া আফগান ভূখণ্ডে পশ্চিমা প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করছে এবং নিজের কৌশলগত উপস্থিতি দৃঢ় করছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও কূটনৈতিক ভারসাম্য

২০২১ সালে আফগানিস্তানে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর প্রত্যাহারের পর তালেবান ফের ক্ষমতায় ফিরে আসে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো পশ্চিমা রাষ্ট্র তালেবান সরকারকে বৈধতা দেয়নি। তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে নারী অধিকার হরণ, মেয়েদের শিক্ষা বন্ধ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়নের মতো অভিযোগ।

জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা তালেবান সরকারের এসব কার্যকলাপের তীব্র সমালোচনা করেছে। ফলে রাশিয়ার এই স্বীকৃতি একদিকে যেমন তালেবান সরকারের বৈধতা অর্জনে সহায়ক, অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্ব ও রাশিয়ার মধ্যকার মতপার্থক্যকে আরও প্রকট করতে পারে।

তালেবান সরকারের অভ্যন্তরীণ অবস্থা

তালেবান নেতৃত্বাধীন সরকারের বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা এখনও সীমিত। সরকার কার্যত শুধুমাত্র পুরুষদের দ্বারা পরিচালিত, কোন গণতান্ত্রিক বা প্রতিনিধিত্বশীল কাঠামো নেই। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সহায়তা হ্রাস, বৈদেশিক রিজার্ভে নিষেধাজ্ঞা এবং অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা আফগানিস্তানের অর্থনীতিকে ধ্বংসপ্রায় অবস্থায় নিয়ে গেছে।

রাশিয়ার স্বীকৃতি হয়তো তালেবান সরকারের কূটনৈতিক রূপরেখা তৈরি করতে সাহায্য করবে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয় যদি বৃহৎ দাতাসংস্থা ও আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ তালেবান প্রশাসনের দায়িত্বশীলতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে চলে।

রাশিয়ার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে?

বিশ্লেষকদের মতে, স্বীকৃতির পরবর্তী ধাপে রাশিয়া আফগানিস্তানে পূর্ণ কূটনৈতিক মিশন চালু করতে পারে, যৌথ অর্থনৈতিক কমিশন গঠন করতে পারে এবং সম্ভবত কিছু অবকাঠামো প্রকল্পেও বিনিয়োগ শুরু করবে। আফগানিস্তানে রুশ তেল, গ্যাস, কৃষি, খনিজ ও যোগাযোগ খাতে পুঁজি প্রবাহ বাড়ানোর ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

তবে এ বিষয়টি নির্ভর করবে আফগানিস্তানের নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক স্থিতিশীলতার ওপর। যদি তালেবান সরকার বিশ্ব সম্প্রদায়ের সঙ্গে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়, তবে রাশিয়ার এই আগ্রহ আরও শক্তিশালী হতে পারে।

বিশ্বরাজনীতিতে রাশিয়ার নতুন কৌশল

বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় যখন বহু রাষ্ট্র তাদের পররাষ্ট্রনীতিকে পুনর্গঠনের দিকে যাচ্ছে, রাশিয়া তার ভূ-রাজনৈতিক কৌশলকে বহুমুখী করছে। সিরিয়া, ইরান, উত্তর কোরিয়া, ভেনিজুয়েলা, এখন আফগানিস্তান—এই তালিকায় রাশিয়া তার নিজস্ব কূটনৈতিক বলয় তৈরি করছে।

এই নতুন ব্লক জাতিসংঘের মতো বিশ্বমঞ্চে প্রভাব বিস্তারে পশ্চিমা আধিপত্যের বিকল্প হিসেবে দাঁড়াতে পারে, যদিও এদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বা সাংগঠনিক স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

সংক্ষেপে মূল বিষয়গুলো:

  • রাশিয়া বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে তালেবান সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিয়েছে
  • ক্রেমলিন তালেবানের রাষ্ট্রদূতের পরিচয়পত্র গ্রহণ করেছে
  • তালেবানকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে আর গণ্য করছে না রাশিয়ার আদালত
  • অর্থনৈতিক, কৌশলগত ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা রক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে সিদ্ধান্তটি নেওয়া
  • পশ্চিমা বিশ্ব এখনও তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিতে নারাজ
  • আফগানিস্তানের ভবিষ্যত কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা রাশিয়ার এই পদক্ষেপের ওপর নির্ভর করছে
মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button