হঠাৎ যুদ্ধাস্ত্রের উৎপাদন বাড়ানোর ঘোষণা দিল রাশিয়া

ইউক্রেন যুদ্ধ চলমান, প্রতিরক্ষা খাতে নতুন দিকনির্দেশনা দিয়েছে মস্কো। প্রেসিডেন্ট পুতিনের পরামর্শে সবধরনের অস্ত্র তৈরিতে জোরালো পদক্ষেপ নিচ্ছে দেশটির সরকার। এ পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
রাশিয়ার ঘোষণা: সব ধরনের যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদনে গতি আনছে মস্কো
রাশিয়া এবার সরাসরি ঘোষণা দিল—সব ধরনের যুদ্ধাস্ত্রের উৎপাদন বাড়ানো হবে। দেশটির শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী আন্তন আলিখানোভ নিজেই এই ঘোষণা দিয়েছেন। রাশিয়ার পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ‘দুমা’য় দেওয়া এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘‘আমাদের সব অস্ত্র কারখানা এখন সম্পূর্ণ উৎপাদনে আছে। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণ কর্মসূচিকে আরও শক্তিশালী করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’’
এমন সময়ে রাশিয়া এই সিদ্ধান্ত নিল যখন ইউক্রেন যুদ্ধ তৃতীয় বছরে প্রবেশ করেছে এবং পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে টানাপোড়েন দিন দিন তীব্র হচ্ছে।
পেছনের কারণ: ইউক্রেন যুদ্ধ ও বিশ্ব রাজনীতির চাপ
২০২২ সালের শুরু থেকে ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে। এই যুদ্ধ রাশিয়ার সামরিক শক্তিকে একদিকে ব্যস্ত রাখছে, অন্যদিকে অস্ত্রভাণ্ডারেও চাপ সৃষ্টি করছে। দেশটির সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখতে গিয়ে, তাদের নিজস্ব উৎপাদন ব্যবস্থাকে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, কেবল ইউক্রেন যুদ্ধই নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো দেশগুলোর প্রতিক্রিয়াও রাশিয়ার সামরিক প্রস্তুতি জোরদার করার অন্যতম কারণ।
অস্ত্র রপ্তানি বাজারেও রাশিয়ার নজর
রাশিয়া কেবল নিজেদের বাহিনীর জন্যই নয়, বরং আন্তর্জাতিক অস্ত্র বাজারেও একটি বড় অংশীদার। দেশটির প্রধান অস্ত্র ক্রেতাদের মধ্যে রয়েছে ভারত, চীন, মিসর, আলজেরিয়া, ভিয়েতনামসহ আরও অন্তত ১০টি দেশ।
এসব দেশের সঙ্গে রাশিয়ার চুক্তি অনুযায়ী নিয়মিত অস্ত্র সরবরাহ নিশ্চিত করাও তাদের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেও রাশিয়া রপ্তানির বাজার ধরে রাখতে চাইছে, যা তাদের অর্থনীতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
স্টকহোমের রিপোর্টে উঠে এসেছে বাস্তব চিত্র
সুইডেনভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক সংস্থা ‘স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ (সিপ্রি) সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, রাশিয়া বর্তমানে বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম অস্ত্র উৎপাদনকারী দেশ।
প্রথম এবং দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স। সিপ্রির মতে, রাশিয়ার অস্ত্র উৎপাদনের সক্ষমতা আগের তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে এবং ভবিষ্যতে এ প্রবণতা আরও বাড়বে।
বিশাল প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য প্রয়োজন বিপুল অস্ত্র
রাশিয়ার আয়তন বিশাল, তেমনি তাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যসংখ্যাও বিপুল। এই বিশাল বাহিনীর অস্ত্র চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত নতুন অস্ত্র তৈরি করতে হয়।
পূর্ব ইউরোপে পশ্চিমা সামরিক জোটের (ন্যাটো) তৎপরতা বাড়ছে, যা রাশিয়াকে আরও বেশি সতর্ক এবং প্রস্তুত থাকতে বাধ্য করছে। রাশিয়ার সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদন বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
পুতিনের নেতৃত্বে আরও ‘অ্যাগ্রেসিভ’ স্ট্র্যাটেজি
ভ্লাদিমির পুতিন বরাবরই তার জোরালো কূটনৈতিক ও সামরিক অবস্থানের জন্য পরিচিত। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ও অর্থনৈতিক চাপে পড়লেও, তিনি কখনো আত্মসমর্পণমূলক মনোভাব দেখাননি। বরং নিজের দেশকে স্বনির্ভর সামরিক শক্তিতে রূপান্তরিত করতে একের পর এক পদক্ষেপ নিয়েছেন।
অন্তন আলিখানোভের মতে, “প্রেসিডেন্ট পুতিনের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী অস্ত্র নির্মাণ প্রকল্পে আরও গতি আনা হচ্ছে। সরকার এই খাতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে।”
বৈশ্বিক উত্তেজনা কি আরও বাড়বে?
রাশিয়ার এই নতুন ঘোষণা বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে।
নিরস্ত্রীকরণ ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পক্ষে কাজ করা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এই সিদ্ধান্তকে বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি হিসেবেই দেখছে।
তবে রাশিয়া বলছে, তাদের এই উদ্যোগ আত্মরক্ষার জন্য, আক্রমণের উদ্দেশ্যে নয়।
বিশ্ব রাজনীতির একাধিক বিশ্লেষক মনে করছেন, পরবর্তী সময়ে পশ্চিমা দেশগুলোও অস্ত্র উৎপাদন বাড়ানোর পথে হাঁটতে পারে, ফলে এক ধরনের নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হতে পারে।
“আমাদের অস্ত্র কারখানাগুলো পূর্ণ সক্ষমতায় চলছে। দেশের প্রতিরক্ষা ও আন্তর্জাতিক চাহিদা মেটাতে যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদন বাড়ানো ছাড়া বিকল্প নেই” — আন্তন আলিখানোভ, রাশিয়ার শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা কী?
রাশিয়ার যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদন বৃদ্ধির ঘোষণা নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ঘটনা। এটি কেবল ইউক্রেন যুদ্ধকে নয়, বরং বৈশ্বিক সামরিক ভারসাম্যকেও প্রভাবিত করতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, এ ধরনের সিদ্ধান্তের ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অস্ত্র প্রতিযোগিতা বাড়বে, যা দীর্ঘমেয়াদে শান্তির বদলে সংঘর্ষের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
তবে সবশেষে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে—এমন পদক্ষেপের পর পৃথিবী কি নিরাপদ থাকবে, না কি আরও অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হবে?
এম আর এম – ০১৬১, Signalbd.com