গুপ্তচর সন্দেহে লাখো আফগানকে ফেরত পাঠাচ্ছে ইরান

ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের পর জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে আফগানদের ধরপাকড় শুরু করেছে তেহরান। জাতিসংঘ বলছে, প্রতিদিন গড়ে ৩০ হাজার আফগানকে দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। এতে অস্থির হয়ে উঠছে আফগানিস্তানের মানবিক পরিস্থিতি।
সম্প্রতি ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের পর ইরানে অবস্থানরত আফগান নাগরিকদের বিরুদ্ধে গুপ্তচরের অভিযোগ এনে লাখো মানুষকে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে তেহরান। জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, কারণ আফগানিস্তান নিজেই বর্তমানে চরম সংকটে রয়েছে।
ঘটনার বিস্তারিত
ইরান সরকারের মুখপাত্র ফাতেমেহ মোহাজেরানি জানান, “জাতীয় নিরাপত্তা আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। যারা অবৈধভাবে ইরানে বসবাস করছেন, তাদেরকে দেশে ফেরত পাঠানো হবে।” যদিও তিনি সরাসরি গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ নিয়ে কিছু বলেননি, তবে বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা।
ইরান সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, অনেক আফগান ‘অবৈধ অভিবাসী’ হিসেবে বসবাস করছিলেন এবং তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে কাজ করছে এমন সন্দেহ রয়েছে।
২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকেই লাখো আফগান ইরানে আশ্রয় নেন। জাতিসংঘের তথ্য মতে, ২০২২ সালে ইরানে প্রায় ২৬ লাখ আফগান বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই বসবাস করছিলেন। তবে সাম্প্রতিক ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের পর থেকে ইরান এই জনগোষ্ঠীর ওপর সন্দেহমূলক আচরণ শুরু করে।
এনায়েতুল্লাহ আসঘারি নামে এক আফগান নাগরিক বলেন, “আমরা শুধু কাজ করতে এসেছিলাম। কিন্তু হঠাৎ একদিন বলা হলো, আমরা নাকি গুপ্তচর!”
প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা জানায়, ইরান প্রতিদিন গড়ে ৩০ হাজারের বেশি আফগানকে ফেরত পাঠাচ্ছে। এই হারে চলতে থাকলে আগামী মাসের মধ্যেই প্রায় ১০ লাখ আফগান ইরান ছাড়তে বাধ্য হবেন।
ইউএনএইচসিআরের আফগান প্রতিনিধি আরাফাত জামাল বলেন, “আফগানদের বলির পাঁঠা বানানো হচ্ছে। যুদ্ধের রেশ তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।”
ইরানে অবস্থানরত আফগানরা বলছেন, রাস্তাঘাটে, বাজারে এমনকি নির্মাণ সাইটেও পুলিশ তল্লাশি চালাচ্ছে। তাদের মোবাইল ফোন জব্দ, কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও আটক করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
পরিসংখ্যান ও তুলনা
জাতিসংঘের তথ্যমতে, ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে ইরান ও পাকিস্তান থেকে ১২ লাখের বেশি আফগান ফেরত পাঠানো হয়েছে। শুধু জুন মাসেই ইরান ছেড়েছে ২ লাখ ৫০ হাজারের বেশি মানুষ।
এদিকে ইউনিসেফ জানিয়েছে, ফেরত পাঠানোর সময় ৫ হাজারের বেশি আফগান শিশু তাদের পরিবারের থেকে আলাদা হয়ে গেছে, যা একটি ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দেয়।
বিশেষজ্ঞ মতামত
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরান পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। যুদ্ধ শেষে নিজস্ব ক্ষোভ আফগানদের ওপর ঝাড়ছে দেশটি। এর ফলে আফগানিস্তানে বাড়তে পারে সহিংসতা, চরমপন্থা ও দারিদ্র্য।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক রামিন ফারহাদ বলেন, “ইরান মূলত নিরাপত্তার ছদ্মাবরণে মানবাধিকারের লঙ্ঘন করছে।”
অন্যদিকে, তালেবান সরকার এই বিষয়ে এখনো কোনো স্পষ্ট বিবৃতি দেয়নি, যা ভবিষ্যতের জন্য উদ্বেগের বিষয়।
“তাঁরা আমাদের গুপ্তচর ভাবে — সাধারণ মানুষ, পুলিশ, সবাই বলত আমরা তাদের ভেতর থেকে ধ্বংস করেছি”—আফগান নাগরিক এনায়েতুল্লাহ আসঘারি
সারসংক্ষেপঃ
ইরানের বর্তমান নীতির কারণে আফগানিস্তান আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। এর প্রভাব শুধু দেশটির ভেতরে সীমাবদ্ধ না থেকে ছড়িয়ে পড়তে পারে গোটা দক্ষিণ এশিয়ায়।
বিশ্লেষকদের মতে, ইরান যদি এই পুনর্বাসন নীতি বন্ধ না করে, তবে সামনে ভয়াবহ মানবিক সঙ্কট অপেক্ষা করছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এ সংকটের দায়ভার কে নেবে? বিশ্ব কি মুখ ফিরিয়ে নেবে, নাকি কোনো কার্যকর উদ্যোগ আসবে?
এম আর এম – ০১৫২, Signalbd.com