বিশ্ব

মহারাষ্ট্রে ৩ মাসে ৭৬৭ কৃষকের আত্মহত্যা কারণ ও সমাধান

২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত মাত্র তিন মাসে ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যে আত্মহত্যা করেছেন মোট ৭৬৭ জন কৃষক। এই ভয়াবহ পরিসংখ্যান গতকালেরই খবর। অধিকাংশ আত্মহত্যা ঘটেছে রাজ্যের বিদর্ভ অঞ্চলে, যা কৃষক সংকটের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

মহারাষ্ট্র বিধানসভায় সরকারের পক্ষ থেকে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। কৃষক মৃত্যুর সংখ্যা এতটা বেড়ে যাওয়ার পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ — ঋণের বোঝা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া এবং সরকারি সহায়তার অপ্রতুলতা।

মহারাষ্ট্রে কৃষকদের চরম সংকটের কারণ

১. ঋণের বোঝা ও আর্থিক চাপ

অনেক কৃষক জমি ও ফসলের জন্য ব্যাংক কিংবা ঠাকুরদারদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে থাকেন। কিন্তু ফসল নষ্ট হলে বা বাজারে ভালো দাম না পেলে তারা ঋণ শোধ করতে অক্ষম হয়ে পড়েন। এই ঋণের বোঝা অনেক সময় কৃষকদের মানসিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে এবং তারা মৃত্যুকেই একমাত্র সমাধান মনে করেন।

২. প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অকাল বর্ষণ

বিদর্ভ অঞ্চলে অকাল বর্ষণ, অতিবৃষ্টি, তীব্র গরমসহ নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রতিবার ফসলের ক্ষতি করে। এতে কৃষকের উৎপাদন কমে যায়, আর ক্ষতিপূরণের প্রক্রিয়া অনেক সময়ে দেরিতে হওয়ার কারণে তাদের আর্থিক অবস্থা আরও খারাপ হয়।

৩. ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া

আধুনিক কৃষি ব্যবস্থায় কৃষকরা প্রায়ই তাদের ফসলের ন্যায্য দাম পান না। মাঝারি ব্যবসায়ীরা ও মধ্যস্বত্বভোগীরা তাদের ফসলের দাম কমিয়ে দিয়ে লাভবান হন, আর কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হন।

৪. সরকারি সহায়তার অপ্রতুলতা ও জটিলতা

সরকারি বিভিন্ন যোজনা যেমন কৃষক সম্মান যোজনা থেকে বছরে ছয় হাজার টাকা সহায়তা দেওয়া হলেও, সেই সাহায্য কৃষকদের বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট নয়। তাছাড়া, অনেক কৃষক সরকারি ক্ষতিপূরণ পাওয়ার যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারেন না, যার ফলে তারা সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন।

সরকারের পদক্ষেপ ও বিরোধীদের প্রশ্ন

মহারাষ্ট্র বিধানসভায় এনসিপি নেতা ও ত্রাণমন্ত্রী মরকন্দ পাটিল জানিয়েছেন, আত্মহত্যা করেছেন এমন কৃষকদের পরিবারকে এক লাখ টাকা সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ৭৬৭ জনের মধ্যে মাত্র ৩৭৬ জনই এই সাহায্য পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। বাকিরা নানা কারণে সরকারি সাহায্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।

সরকার জানিয়েছে, অকাল বর্ষণ এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে। তবুও আত্মহত্যার সংখ্যা কমছে না। এর পেছনে যেসব প্রশাসনিক জটিলতা ও ত্রুটি রয়েছে, সেটি বিরোধী দলগুলোর তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে।

বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ

কংগ্রেস ও অন্যান্য বিরোধী দলগুলোর মতে, বর্তমান দেবেন্দ্র ফাডনবিশ নেতৃত্বাধীন মহারাষ্ট্র সরকার কৃষকদের সমস্যা বুঝতে ব্যর্থ। তাদের দাবি, সরকার যথেষ্ট মানবিক নীতিমালা গ্রহণ করছে না এবং ক্ষতিপূরণ প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল ও অস্পষ্ট।
বিরোধীরা আরও অভিযোগ করেন, কৃষকদের বঞ্চনার জন্য আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও সরকারি উদাসীনতা দায়ী। কৃষকদের জীবন বাঁচাতে এবং তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি করতে তৎপর হওয়ার পরিবর্তে সরকার কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষায় বেশি মনোযোগ দিচ্ছে।

বিদর্ভ অঞ্চলের অবস্থা সবচেয়ে সংকটজনক

বিদর্ভ অঞ্চলে ২৫৭ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। যদিও সরকারের তালিকা যাচাইয়ের পর নিশ্চিত হওয়া যায়নি, তালিকাভুক্ত ১৯৪ জন কৃষকের মৃত্যুর কারণ ১০০% আত্মহত্যা কিনা। বিদর্ভের কৃষকরা দীর্ঘদিন ধরেই ঋণ, বাম্পার ফসলের জন্য ফসলের দাম কম পাওয়া, এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অর্থনৈতিক দিক থেকে দুর্দশাগ্রস্ত। ফলে আত্মহত্যার হারও বেশি।

সাম্প্রতিক বছরগুলোর পরিসংখ্যান ও প্রভাব

মহারাষ্ট্রে ২০২৩ সালে কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল ২,৮৫১। ২০২৪ সালে কিছুটা কমে ২,৬৩৫-এ এসে দাঁড়ায়। কিন্তু ২০২৫ সালের প্রথম তিন মাসে এক হাজারের কাছাকাছি ৭৬৭ জন কৃষকের আত্মহত্যা শংকাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিরোধীরা অভিযোগ করেন, এই প্রাণঘাতী পরিসংখ্যানের পরেও সরকার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ফলে কৃষকরা যখন একাধিক সমস্যায় নিপতিত, তখন আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে না।

কৃষক সুরক্ষায় কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?

১. ঋণের পুনর্গঠন ও মওকুফ: ঋণমুক্তির ব্যবস্থা করে কৃষকদের আর্থিক চাপ কমাতে হবে। সরকারের উচিত ঋণ মওকুফ, সুদের হ্রাস এবং সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করা।

২. ক্ষতিপূরণ দ্রুত নিশ্চিতকরণ: প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের দ্রুত ও পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। প্রশাসনিক জটিলতা দূর করে সেবার মান উন্নত করতে হবে।

৩. ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ: কৃষকের ফসল ন্যায্য দামে বিক্রির জন্য বাজার নিয়ন্ত্রণ ও কৃষক বাজার প্রতিষ্ঠা করা দরকার।

৪. সামাজিক ও মানসিক সহায়তা: কৃষকদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় সঠিক পরামর্শ ও সহায়তা কার্যক্রম চালু করা উচিত।

৫. সরকারি যোজনার কার্যকর বাস্তবায়ন: প্রধানমন্ত্রী কিষাণ সম্মান যোজনা এবং রাজ্য সরকারের অতিরিক্ত সহায়তা প্রকৃত কৃষকদের কাছে পৌঁছানো নিশ্চিত করতে হবে।

মহারাষ্ট্রের কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় সমগ্র জাতির সামনে একটি গুরুতর সংকট দাঁড়িয়েছে। কৃষকরা দেশের খাদ্য নিরাপত্তার মূল স্তম্ভ, তাই তাদের সুরক্ষা ও উন্নতি নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। সরকার এবং সমাজের সকল অংশের দায়িত্ব, যেন কৃষকেরা নিরাপদ, সুস্থ এবং সম্মানের সঙ্গে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। অন্যথায়, চলমান আত্মহত্যার হার শুধুমাত্র রাজ্য নয়, সারা দেশের জন্য বিপজ্জনক সংকেত বহন করবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button