বিশ্ব

জাতিসংঘের পরমাণু সংস্থা থেকে বেরিয়ে গেল ইরান

শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে হামলার প্রতিবাদে তেহরানের কড়া সিদ্ধান্ত

ইরান আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘের পরমাণু শক্তি সংস্থা (IAEA) থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। সাম্প্রতিক সামরিক উত্তেজনা ও আস্থাহীনতার প্রেক্ষিতে এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

এর ফলে বহু বছরের আন্তর্জাতিক পরমাণু পর্যবেক্ষণ কাঠামোর বাইরে গেল তেহরান, যা বিশ্ব রাজনীতিতে এক নতুন জটিলতা তৈরি করেছে।

তেহরানের ঘোষণা: বন্ধ হলো সব সহযোগিতা

ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা জানায়, প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান একটি নতুন আইনে স্বাক্ষর করেছেন, যার ফলে IAEA-এর সঙ্গে ইরানের সব ধরনের সম্পর্ক ও সহযোগিতা স্থগিত করা হয়েছে।

এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সংস্থার কোনো পরিদর্শক এখন থেকে ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোতে প্রবেশ করতে পারবে না। শুধু তা-ই নয়, অতীতের সব যৌথ চুক্তিও এখন বাতিল বলে গণ্য।

আইনের পেছনে পার্লামেন্টের অনুমোদন

এই সিদ্ধান্ত একদিনে আসেনি। গত সপ্তাহেই ইরানের পার্লামেন্টে একটি আইন পাস হয়, যেখানে IAEA-এর সঙ্গে সম্পর্ক স্থগিতের প্রস্তাব রাখা হয়।

এরপর প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান সেই আইনে স্বাক্ষর করে তা কার্যকর করেন। তেহরানের মতে, এই পদক্ষেপ ‘জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব’ রক্ষার অংশ।

হামলা ও নিন্দার অভাব

গত ১৩ জুন ইসরায়েল ইরানের একটি পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রসহ কয়েকটি সামরিক স্থাপনায় বিমান হামলা চালায়। পাল্টা জবাবে ইরানও হামলা চালায় তেল আবিবের বিভিন্ন স্থানে।

এই সংঘর্ষে যুক্তরাষ্ট্রও জড়িয়ে পড়ে এবং তারা ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা ফেলে।

তেহরানের অভিযোগ—IAEA, বিশেষ করে সংস্থার প্রধান রাফায়েল গ্রোসি, এই হামলার কোনো নিন্দা জানাননি। এই নীরবতাকে তারা ‘একপেশে ও পক্ষপাতদুষ্ট’ বলেই মনে করে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

IAEA এক বিবৃতিতে বলেছে, “আমরা ইরানের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অবগত হয়েছি এবং আনুষ্ঠানিক তথ্যের জন্য অপেক্ষা করছি।”

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পদক্ষেপে শুধু ইরানের অবস্থানই বদলাবে না, বরং গোটা আন্তর্জাতিক পারমাণবিক পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার উপর প্রভাব পড়বে।

বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলো এখন ইরানের প্রকৃত পরমাণু কার্যক্রম সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবে না, যা উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।

তবে কি গোপন কর্মসূচি?

ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র বহুদিন ধরেই দাবি করে আসছে, ইরান গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে। যদিও ইরান এ অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করেছে এবং বলেছে তাদের কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে।

তবে IAEA-এর উপস্থিতি না থাকলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সন্দেহ বেড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।

তেহরানের অবস্থান: নিরাপত্তাই প্রধান বিবেচনা

ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি এক্স (পূর্বে টুইটার)-এ এক পোস্টে লিখেছেন, “IAEA যে এখন হামলাগ্রস্ত স্থাপনাগুলো ঘুরে দেখতে আগ্রহী, তা নিছক নিরাপত্তার প্রশ্ন নয়; বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও থাকতে পারে।”

তিনি আরও বলেন, “আমরা আমাদের জনগণ, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত।”

ভেতরের উত্তেজনা

ইরানের রক্ষণশীল দৈনিক ‘কায়হান’ এক প্রতিবেদনে IAEA প্রধানকে ইসরায়েলের গুপ্তচর বলে অভিহিত করেছে এবং তার বিচার দাবি করেছে। যদিও সরকারিভাবে ইরান এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নয়।

তবে জনমতের বিশাল অংশই সরকারের কঠোর অবস্থানকে সমর্থন করছে, বিশেষ করে এমন সময় যখন দেশের ভেতরে-বাইরে চাপে রয়েছে তেহরান।

ভবিষ্যতের আশঙ্কা: সংঘাত না কূটনীতি?

বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এই সিদ্ধান্তের ফলে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হয়তো ইরানের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা ভাবতে পারে।

তবে কিছু কূটনীতিক আশাবাদী—তেহরান হয়তো ভবিষ্যতে শর্তসাপেক্ষে IAEA-এর সঙ্গে নতুন কাঠামোয় আলোচনায় ফিরতে পারে।

শেষ কথা

ইরানের এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। প্রশ্ন হচ্ছে—এই উত্তেজনা কোথায় গিয়ে থামবে? বিশ্ব কি আরেকটি বড় সংঘাতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, নাকি কূটনীতি আবারও তা রুখে দেবে?

এম আর এম – ০১৪২, Signalbd.com

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button