বিশ্ব

জোহরান মামদানি: নিউইয়র্ক সিটির তরুণ মেয়র প্রার্থীর প্রতিশ্রুতি ও যাত্রা

নিউইয়র্ক সিটির রাজনীতিতে এক নতুন তরুণ ও উদ্যমী ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন জোহরান মামদানি। মাত্র ৩৩ বছর বয়সী এই ডেমোক্র্যাট প্রার্থী ইতিমধ্যে শহরের তরুণ, অভিবাসী ও শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে ব্যাপক আস্থা ও সাড়া ফেলেছেন। কিন্তু তাঁর আশাব্যঞ্জক প্রতিশ্রুতিগুলো কতটা বাস্তবায়নযোগ্য? কতটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে? চলুন জানি বিস্তারিত।

জোহরান মামদানির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও পরিচিতি

উগান্ডায় জন্ম নেওয়া ও নিউইয়র্কে বড় হওয়া এই তরুণ প্রার্থী ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্ট হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিচ্ছেন। তিনি বিলিয়নিয়ার পৃষ্ঠপোষকতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের জন্য তাদেরকে বড় হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। নিউইয়র্ক টাইমসসহ অনেক বিশ্লেষক তাকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরেই অন্যতম প্রভাবশালী নতুন নাম হিসেবে দেখছেন। নিউইয়র্কের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যের মাঝে তিনি তরুণ ও অভিবাসী সমাজের আশা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন।

নিউইয়র্কবাসীর ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে নতুন উদ্যোগ

নিউইয়র্ক বিশ্বখ্যাত একটি শহর হলেও সাধারণ মানুষের জন্য এটি সুলভ নয়—এই কথাই বারবার উল্লেখ করেন জোহরান। শহরের উচ্চ জীবনযাত্রার খরচ সাধারণ মানুষের পক্ষে বহনযোগ্য নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন। এই সমস্যা সমাধানে তাঁর পরিকল্পনা খুবই অনন্য ও সাহসী।

তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন শহরের প্রতিটি বরোতে সরকারি মালিকানাধীন গ্রোসারি শপ চালুর, যা পাইকারি মূল্যে পণ্য সরবরাহ করবে। এই দোকানগুলো প্রোপার্টি ট্যাক্স থেকে মুক্ত থাকবে, যার ফলে পণ্যের দাম কমানো সম্ভব হবে। করপোরেট কর বাড়িয়ে ও সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশের ওপর এককালীন কর আরোপ করে তিনি এ প্রকল্পের জন্য অর্থ সংগ্রহ করবেন।

বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সহজ নয়। কর বাড়ানো বা নতুন কর আরোপের জন্য রাজ্য আইনসভা এবং গভর্নরের সম্মতি প্রয়োজন। পাশাপাশি, উচ্চ কর আরোপে ব্যবসা ও ধনীদের অন্যত্র স্থানান্তরের ঝুঁকিও থেকে যায়।

পরিবহন ব্যবস্থা ও বিনামূল্যে বাস চলাচলের স্বপ্ন

নিউইয়র্কের জমজমাট পরিবহন ব্যবস্থায় বিনামূল্যে বাস চালানোর প্রস্তাব নিয়ে জোহরান বেশ আলোচনায় রয়েছেন। ২০২৩ সালে গভর্নরের সঙ্গে কাজ করে পাইলট প্রকল্প চালু করেন তিনি, যেখানে পাঁচটি বাস রুটে বিনামূল্যে যাত্রী পরিবহন করা হয়। যদিও প্রকল্প নবায়ন না হওয়ায় তা সম্প্রসারণ সম্ভব হয়নি।

পরিবহন খাতে কনজেশন প্রাইসিং সমর্থন করলেও, আইনি ও রাজনৈতিক বাধা এটিকে বাস্তবায়নে বাধাগ্রস্ত করছে। সাবওয়ে, বাসের সেবা উন্নয়নে বেশি তহবিল বরাদ্দ এবং বিশেষ করে উইকএন্ড ও রাতের সেবা বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছেন জোহরান। শহরের নাগরিকদের জন্য বিনামূল্যে পরিবহনের স্বপ্ন বাস্তবায়নে তার পরিকল্পনা অন্তত ৭০ কোটি ডলার বার্ষিক বাজেট দাবি করে।

আবাসনের উচ্চ মূল্য এবং ভাড়া স্থগিতকরণের প্রতিশ্রুতি

নিউইয়র্কের বাসিন্দাদের জন্য আবাসনের উচ্চ খরচ একটি বড় সমস্যা। জোহরান এই সমস্যা সমাধানে রেন্ট গাইডলাইনস বোর্ডে নিজের পছন্দের সদস্য নিয়োগ দেওয়ার কথা বলেছেন, যাতে ভাড়া বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং প্রায় ১০ লাখ মানুষের ভাড়া স্থগিত রাখা যায়।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রেন্ট গাইডলাইনস বোর্ড একটি স্বাধীন সংস্থা এবং সেখানে রাতারাতি পরিবর্তন আনা সহজ নয়। বাড়িওয়ালাদের বিরোধিতা ও আইনি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। তবুও তিনি আগামী দশ বছরে ২ লাখ নতুন সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন নির্মাণ এবং সরকারি আবাসন সংরক্ষণে ব্যয় দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

অভিবাসী ও স্যাংকচুয়ারি ল’জের জন্য নতুন পরিকল্পনা

উগান্ডায় জন্ম নেওয়া জোহরান বলেছেন, নিউইয়র্কের অভিবাসীদের জন্য স্যাংকচুয়ারি ল’জকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। এই আইনের মাধ্যমে অভিবাসীরা সরকারী সেবা গ্রহণে স্বচ্ছন্দ বোধ করবে এবং পুলিশি নির্যাতন থেকে মুক্ত থাকবে।

তিনি অভিবাসীদের জন্য আইনি সহায়তা বৃদ্ধি এবং ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসনের সময় স্যাংকচুয়ারি ল’জ ব্যাপক আক্রমণের শিকার হয়েছিল, যা স্থানীয় ও ফেডারেল সরকারের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করেছিল।

শিশুর যত্ন ও শিক্ষার খাতে বিনিয়োগ

শিশুর যত্ন ও শিক্ষা খাতে বিনামূল্যে পরিষেবা প্রদানের পরিকল্পনা জোহরানের নির্বাচনী ইশতেহারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ছয় সপ্তাহ থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের জন্য বিনামূল্যে শিশুযত্ন, নতুন অভিভাবকদের জন্য ‘বেবি বাস্কেট’ বিতরণ এবং সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের শিক্ষার্থীদের জন্য টিউশন ফি মুক্তির প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি।

স্কুল এলাকার রাস্তা বন্ধ করে নিরাপত্তা বাড়ানো এবং দূষণ কমানোও তার পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে। এই সব উদ্যোগ অর্থনৈতিক দিক থেকে চ্যালেঞ্জিং হলেও তিনি এগুলো বাস্তবায়নের দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।

চ্যালেঞ্জ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা: জোহরান মামদানির সামনে বাধা

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফাহমিদুল হকের মতে, জোহরান নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন ‘ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্ট’ হিসেবে। বর্তমানে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির অনেক বড় অংশ বিলিয়নিয়ারদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। জোহরান এই নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে নতুন এক হাওয়া সৃষ্টি করতে পারেন।

তবে রিপাবলিকানরা, ডেমোক্র্যাটিক পার্টির কিছু প্রভাবশালী গোষ্ঠী এবং সম্পদশালী শ্রেণি তার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীল। এর পাশাপাশি, পরাজিত ডেমোক্র্যাট প্রার্থী ও বর্তমান মেয়র স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন, যা লড়াইকে তীব্রতর করেছে।

ফাহমিদুল হক মনে করেন, ধনীদের ওপর কর বাড়িয়ে জোহরানের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব, তবে তার জন্য শক্তিশালী রাজনৈতিক সমর্থন এবং ধৈর্য্য দরকার।

জোহরান মামদানির প্রতিশ্রুতি এবং পরিকল্পনা নবীন, ধৈর্যশীল এবং কখনো কখনো বিপ্লবী হলেও বাস্তবায়নে নানা রাজনৈতিক, আর্থিক ও সামাজিক বাধার সম্মুখীন। নিউইয়র্ক শহরের জন্য তার স্বপ্ন যদি বাস্তবে রূপ পায়, তবে তা হবে সাধারণ মানুষের জন্য একটি নতুন সূর্যের উদয়।

নিউইয়র্কবাসী এবং যুক্তরাষ্ট্রবাসীর চোখ এখন তাঁর ওপর। নতুন প্রজন্মের নেতার এই পথ চলা শুধু নিউইয়র্কেই নয়, বিশ্ব রাজনীতিতেও নতুন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে কিনা, সেটাই এখন অপেক্ষার বিষয়।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button