ইসরায়েলের পার্লামেন্টে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে কড়া অভিযোগ

ইসরায়েলের নেসেট (আইনসভা) সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন, তিনি গাজা যুদ্ধে চলমান সংঘাতকে কাজে লাগিয়ে তাঁর দুর্নীতির মামলার বিচার বন্ধ করার চেষ্টা করছেন। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির আইনপ্রণেতা নামা লাজিমি গতকাল এক বিবৃতিতে বলেন, “নেতানিয়াহু তার দুর্নীতির মামলাকে ইসরায়েল ও আমাদের ভবিষ্যতের ওপর ভারী বোঝা হিসেবে চাপিয়ে দিয়েছেন।”
নামা লাজিমি আরো বলেন, “নেতানিয়াহু বিশ্বাস করেন, তার বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগগুলোকে যুদ্ধের অস্থিরতা ও রাজনৈতিক অবস্থান ব্যবহার করে মীমাংসা করা সম্ভব। তিনি নিজেকে ক্ষমতায় থাকার যোগ্য মনে করেন না, বরং মামলা থেকে বাঁচার জন্য যেকোনো রাস্তা বেছে নিচ্ছেন।”
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত শনিবার আবারও নেতানিয়াহুর দুর্নীতি মামলা থেকে অব্যাহতির দাবি করেন। তিনি বলেন, “আমরা ইসরায়েলের প্রতি যে বিপুল অর্থ বরাদ্দ করি, তা আমাদের দেশের জন্যই। এই কারণে আমরা চাই নেতানিয়াহুকে ক্ষমতায় রাখার জন্য মামলা তুলে নেওয়া হোক।”
ট্রাম্পের এই বক্তব্যের পেছনে নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে বলে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির আইনপ্রণেতা গিলাদ কারিভ উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের টুইট ও বক্তব্য আমাদের দেশের আইনি ব্যবস্থার প্রতি আঘাত। নেতানিয়াহু ও তার ঘনিষ্ঠদের জন্য জাতীয় নিরাপত্তা ও বন্দীদের ব্যবহার করা হচ্ছে।”
ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত: মানবিক সংকট ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ
ফিলিস্তিন স্বাধীনতা সংগঠন হামাস বারবার দাবি করেছে, তারা গাজায় থাকা ইসরায়েলি বন্দীদের মুক্তি দিতে প্রস্তুত, যদি যুদ্ধ বন্ধ হয় এবং ইসরায়েলি সেনারা গাজা থেকে সরে যায়। তবে নেতানিয়াহু এসব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। গাজা উপত্যকায় গত কয়েক বছর ধরে সংঘটিত তাণ্ডব ও হানার কারণে এখন পর্যন্ত ৫৬ হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গাজার গণহত্যামূলক যুদ্ধ চালিয়ে নেতানিয়াহু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও যুদ্ধবিরোধী আইন লঙ্ঘন করছেন। ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত তাকে এবং সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেয়।
দুর্নীতি মামলার বিস্তারিত
নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে—যেমন ঘুষ গ্রহণ, প্রতারণা এবং বিশ্বাসঘাতকতা। এই অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাকে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হতে হতে পারে। ২০১৯ সালের নভেম্বরে এই মামলার অভিযোগপত্র দাখিল হয়। ২০২০ সালের ২৪ মে থেকে নেতানিয়াহুর বিচার শুরু হয়েছে। তিনি ইসরায়েলের ইতিহাসে প্রথম sitting প্রধানমন্ত্রী, যিনি ফৌজদারি মামলার আসামি হয়েছেন।
২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে নেতানিয়াহু মামলার তিনটি মূল কেসের জিজ্ঞাসাবাদে অংশ নিচ্ছেন। যদিও তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করেন।
বিরোধীদলের তীব্র প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েলের বিরোধীদলীয় নেতা ইয়ার লাপিদ মার্কিন প্রেসিডেন্টকে দেশের বিচারব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ না করার আহ্বান জানান। অন্যদিকে, ইয়েশ আতিদ পার্টির আইনপ্রণেতা কারিন এলহারা বলেন, “নেতানিয়াহু দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করছেন। তিনি নিজের বিচারকে জাতীয় নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক চুক্তির সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন।”
রিলিজিয়াস জায়নিজম পার্টির সংসদ সদস্য এবং সংবিধান, আইন ও বিচার কমিটির চেয়ারম্যান সিমচা রথম্যানও ট্রাম্পের আহ্বানকে ‘অনুপযুক্ত’ বলে মন্তব্য করেছেন।
যুদ্ধ ও দুর্নীতির চক্র: নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ঝুঁকির মুখে
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নেতানিয়াহুর এই কৌশল তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। যুদ্ধ ও দুর্নীতির অভিযোগ মিলে ইসরায়েলি জনগণের মধ্যে বিভাজন তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আস্থা কমে আসছে।
আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোও লক্ষ্য করেছেন, গাজা যুদ্ধে যত বেশি মানুষ নিহত হচ্ছে, তত বেশি ইসরায়েলি সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা বাড়ছে। এছাড়া, বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার সংগঠনগুলো নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপের দাবি জানাচ্ছে।
সমাধানের পথ: যুদ্ধবিরতি ও ন্যায্য বিচার
গাজা যুদ্ধের অবসান এবং নেতানিয়াহুর দুর্নীতি মামলার ন্যায্য বিচার যেন একসাথে সম্ভব হয়, সেটাই এখন ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক ও আইনি চাপ সামলাতে গেলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা অপরিহার্য বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
সারসংক্ষেপ
- ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দুর্নীতির মামলা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গাজা যুদ্ধকে ব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
- ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সদস্যরা তাকে এই কৌশল ব্যবহার বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
- মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নেতানিয়াহুকে অব্যাহতির দাবি জানিয়েছেন, যা ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
- ফিলিস্তিনের হামাস যুদ্ধবিরতি ও বন্দী মুক্তির বিনিময়ে ইসরায়েলি বন্দীদের মুক্তির প্রস্তাব দিয়েছে, কিন্তু নেতানিয়াহু তা প্রত্যাখ্যান করেছেন।
- আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত নেতানিয়াহু ও তার ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দিয়েছে।
- বিরোধী দল ও আইনপ্রণেতারা বিচার ব্যবস্থার প্রতি হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করছেন।
এই সংকটময় সময়ে ইসরায়েলের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ও মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি পুনঃস্থাপনের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ খুবই জরুরি।