ভূমি পুরোপুরি ডুবে গেলেও রাষ্ট্রের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকবে আন্তর্জাতিক নতুন আইন

বর্তমান বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের দারুণ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বিশেষ করে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়তে থাকায় অনেক ছোট দ্বীপরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। এমনকি এমনও আশঙ্কা করা হচ্ছে, কিছু দেশের পুরোপুরি ভূমি সমুদ্রতলে তলিয়ে যেতে পারে। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইনের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, কোনো দেশের ভূমি পুরোপুরি হারালেও তার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা, সার্বভৌমত্ব এবং অর্থনৈতিক অধিকার টিকিয়ে রাখা সম্ভব।
আন্তর্জাতিক আইন কমিশনের প্রতিবেদনের বিশ্লেষণ
আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞরা এবং আন্তর্জাতিক আইন কমিশনের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভূমি হারানো বা ডুবে যাওয়া রাষ্ট্রের অস্তিত্বের অবসান ঘটায় না। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, রাজনৈতিক মর্যাদা ও তার আন্তর্জাতিক সম্পদের ওপর অধিকার বজায় থাকে।
এই প্রতিবেদন বিশেষভাবে ছোট দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর জন্য আশার আলো বয়ে আনছে, যারা সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধির কারণে সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে রয়েছে। যেমন, প্রশান্ত মহাসাগরের টুভালু দ্বীপ রাষ্ট্র ইতিমধ্যে এর প্রভাব অনুভব করছে।
টুভালুর বাস্তব পরিস্থিতি ও জলবায়ু সংকট
টুভালু দেশের নয়টি দ্বীপে সমুদ্রপৃষ্ঠ উচ্চতা ইতিমধ্যেই প্রতি বছর গড়ে ৪.৮ মিলিমিটার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে দ্বীপগুলোতে প্লাবন বৃদ্ধি, মিঠা পানির সংকট ও কৃষিক্ষেত্রে লবণাক্ততা বেড়ে গেছে। টুভালুর এক-তৃতীয়াংশ নাগরিক ইতিমধ্যে অস্ট্রেলিয়ার জলবায়ু ভিসার জন্য আবেদন করেছেন।
এই দ্বীপটি জলের নিচে তলিয়ে যাওয়ার সঙ্কটে থাকার কারণে তারা আন্তর্জাতিক সমুদ্রে তাদের মেরিটাইম বাউন্ডারি বা সমুদ্রসীমা সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং বৈশ্বিক দায়
গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির এক-তৃতীয়াংশ দায়ী ১২২টি বৃহৎ জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনকারী ও সিমেন্ট কারখানার। এই শিল্পগুলোর নির্গমন মূলত গ্রিনহাউস গ্যাস বৃদ্ধির প্রধান কারণ।
বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৯০ সেন্টিমিটার বা প্রায় তিন ফুট পর্যন্ত বাড়তে পারে। এই আশঙ্কা বাস্তবে রূপ নিলে, ছোট দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর অস্তিত্ব ঝুঁকির মুখে পড়বে।
রাষ্ট্রের মেরিটাইম বাউন্ডারি বজায় রাখার আইনি অবস্থান
আন্তর্জাতিক আইন কমিশনের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও ভূমি হারানো সত্ত্বেও কোনো রাষ্ট্র তার মেরিটাইম বাউন্ডারি বা সমুদ্রসীমার ওপর অধিকার হারাবে না। এই আইনি দৃষ্টিভঙ্গি দ্বীপরাষ্ট্রগুলোকে আন্তর্জাতিকভাবে তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার রক্ষায় সহায়তা করবে।
এর মাধ্যমে রাষ্ট্রগুলো তাদের জলসম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদ ও বাণিজ্যিক অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখতে পারবে, যা ভবিষ্যতে তাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা
বিশ্বের ক্ষুদ্র ও দ্বীপরাষ্ট্রগুলোকে রক্ষা করতে শুধু আন্তর্জাতিক আইনের স্বীকৃতি যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন ব্যাপক বৈশ্বিক সহযোগিতা ও অর্থায়ন। উন্নত দেশগুলোর দায়িত্ব রয়েছে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানো ও ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রগুলোকে প্রযুক্তি ও আর্থিক সাহায্য প্রদান করা।
আইনের পাশাপাশি, জলবায়ু প্রবণতাগুলোর প্রভাব মোকাবেলায় মাননীয় বিশ্বনেতাদের যৌথ উদ্যোগ জরুরি, যা ছোট দেশগুলোকে সুরক্ষা দিতে সক্ষম হবে।
ভবিষ্যতের ভাবনা ও উদ্যোগ
বৃহৎ জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারকারী দেশগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করে আইন কমিশন ও জলবায়ুবিজ্ঞানীরা বারবার সতর্ক করছেন, দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধি আরও ভয়াবহ রূপ নেবে।
অন্যদিকে ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলোও নিজ নিজ অঞ্চলে জলবায়ু প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম জোরদার করছে। যেমন, টুভালু সরকার গাছ লাগানো, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও সামুদ্রিক বায়ু শক্তি ব্যবহার বাড়াচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাবের মধ্যেও আন্তর্জাতিক আইন এবং বিশ্ব সম্প্রদায়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ক্ষুদ্র ও দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও অধিকার রক্ষার সুযোগ রয়েছে।
এই নতুন আইনগত দৃষ্টিভঙ্গি ছোট দেশগুলোর জন্য আশার আলো, যাদের অস্তিত্ব ভবিষ্যতে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
বিশ্ববাসীর উচিত এখনই ঐক্যবদ্ধ হয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া, যাতে কোনো দেশের ভূমি ডুবে গেলেও তার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকে এবং তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অংশ হিসেবে টিকে থাকতে পারে।