ইসরায়েলের নিশানায় রাজনৈতিক বন্দিও

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্বে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে সামরিক আক্রমণ। শুধু পরমাণু স্থাপনাই নয়, এবার টার্গেট রাজনৈতিক বন্দিদের আবাসও। এভিন কারাগারে হামলায় প্রাণ গেছে ৭১ জনের, আহত আরও শতাধিক। নিহতদের মধ্যে রয়েছে বিদেশি নাগরিকও।
কারাগারে সরাসরি আঘাত
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান ১২ দিনের সংঘাতে এক ভয়ানক মোড় নিয়েছে গত ২৩ জুন। সেদিন ইসরায়েল সরাসরি বিমান হামলা চালায় ইরানের রাজধানী তেহরানের বিখ্যাত এভিন কারাগারে। এই হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৭১ জন। আহত হয়েছেন বহু মানুষ।
নিহতদের মধ্যে রয়েছেন কারাগারের প্রশাসনিক কর্মী, বন্দি, সেনা সদস্য ও তাদের স্বজনরা। এ ঘটনায় নতুন করে আলোচনায় এসেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধবিধির সীমারেখা।
কে ছিলেন নিশানায়? কারা নিহত?
ইরানের বিচার বিভাগের মুখপাত্র আসগর জাহাঙ্গীর জানিয়েছেন, নিহতদের মধ্যে কারাগারে কর্মরত কর্মকর্তা ছাড়াও বন্দি, দর্শনার্থী এবং আশপাশের সাধারণ মানুষ রয়েছেন।
বিশেষ উদ্বেগের বিষয় হলো—এই কারাগারে মূলত রাজনৈতিক বন্দিদের রাখা হয়ে থাকে।
এছাড়া, নিহতদের মধ্যে রয়েছে ইরানি সেনাবাহিনীর কিছু তরুণ সদস্য, যারা কারাগারে বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজে নিযুক্ত ছিলেন। অনেক বন্দির স্বজনও ছিলেন সেখানে, যারা প্রিয়জনদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন।
এই কারাগারে কেন হামলা?
বিশ্লেষকদের মতে, এভিন কারাগার ইরানের রাজনৈতিক প্রতীকী কাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই কারাগারে বহু রাজনৈতিক ব্যক্তি ও বিদেশি নাগরিক দীর্ঘদিন ধরে বন্দি রয়েছেন।
ইরান দাবি করেছে, ইসরায়েল শুধু সামরিক বা পরমাণু স্থাপনায় নয়, বরং ইরানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রতীকী প্রতিষ্ঠানগুলোকেও টার্গেট করছে। এটি একটি কৌশলগত ও মনস্তাত্ত্বিক আঘাত, যা জনমনে ভয় ও বিভ্রান্তি ছড়ানোর উদ্দেশ্যে পরিচালিত।
বিদেশি বন্দিরাও ছিল ঝুঁকিতে
এই হামলার পরে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে দুই ফরাসি নাগরিক — সেসিল কোলার ও জ্যাক প্যারিস। তারা তিন বছর ধরে এভিন কারাগারে বন্দি রয়েছেন।
ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যঁ-নোয়েল বারো এক্সে (সাবেক টুইটার) লিখেছেন, “এই হামলা আমাদের নাগরিকদের জীবন হুমকির মুখে ফেলেছে। এটি সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।”
এই প্রতিক্রিয়ায় বোঝা যাচ্ছে, ইসরায়েলের এই পদক্ষেপ কেবল ইরানের অভ্যন্তরীণ নয়, বরং আন্তর্জাতিক স্তরেও কূটনৈতিক সংকট তৈরি করতে পারে।
১২ দিনের সংঘাতে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি
ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত ৬১০ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ১৩ শিশু ও ৪৯ নারী রয়েছেন।
এই ১২ দিনের সংঘাতে ধ্বংস হয়েছে একাধিক আবাসিক এলাকা, হাসপাতাল ও সরকারি স্থাপনা। কেবল সামরিক ইনস্টলেশন নয়, সাধারণ জনগণকেও টার্গেট করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে ইরান সরকার।
রাজনৈতিক বার্তা নাকি যুদ্ধের উন্মাদনা?
বিশ্লেষকদের মতে, এই ধরনের হামলা কেবল কৌশলগত সাফল্য নয়, বরং এটি একটি রাজনৈতিক বার্তা। রাজনৈতিক বন্দিদের টার্গেট করার মাধ্যমে ইসরায়েল ইরানকে তার রাজনৈতিক ভিত কাঁপিয়ে দেওয়ার সংকেত দিয়েছে।
এক আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, “কারাগারে হামলা একটি ভিন্ন মাত্রার সংকেত। এটি যুদ্ধকে মানবিক বিপর্যয়ে রূপান্তরিত করছে।”
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও উদ্বেগ
এই হামলার পরপরই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও মানবাধিকার সংগঠন তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার এক বিবৃতিতে বলেন, “কারাগারে এ ধরনের আক্রমণ আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘনের সামিল।”
এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আন্তর্জাতিক রেডক্রস ইসরায়েলকে বেসামরিক স্থানে হামলা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে।
ভবিষ্যৎ কি আরও ভয়াবহ?
যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হলেও, উভয় পক্ষের সাম্প্রতিক মন্তব্য ও পদক্ষেপ দেখে বোঝা যাচ্ছে, পরিস্থিতি এখনও উত্তপ্ত। এভিন কারাগারে হামলার মত পদক্ষেপ যদি চলতেই থাকে, তবে ভবিষ্যতে আরও বৃহৎ পরিসরে আন্তর্জাতিক সংঘাতের ঝুঁকি বাড়বে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, “এই ধরণের হামলা যুদ্ধের নিয়মনীতি ও কূটনৈতিক ভারসাম্যকে চ্যালেঞ্জ করছে। পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয়, সেটিই এখন দেখার বিষয়।”
“তেহরানের এভিন কারাগারে হামলা আমাদের নাগরিকদের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলেছে”—জ্যঁ-নোয়েল বারো, ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী
সারসংক্ষেপঃ
ইসরায়েল-ইরান সংঘাতের জেরে শুধু সামরিক নয়, রাজনৈতিক ও মানবিক পরিণতিও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। রাজনৈতিক বন্দিদের আবাসস্থলে আক্রমণ এক ভয়াবহ দৃষ্টান্ত।
প্রশ্ন উঠছে—এ কি নতুন কৌশলগত যুদ্ধের সূচনা? নাকি আন্তর্জাতিক শান্তির ভবিষ্যত আরও অনিশ্চিত হয়ে উঠছে?
এম আর এম – ০০৯৬, Signalbd.com