বেলারুশ দিচ্ছে মিয়ানমারকে আধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা

মিয়ানমারের সামরিক জান্তা দীর্ঘদিন ধরেই দেশটিতে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিপর্যয়ের মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর জন্য বেলারুশ থেকে সরাসরি আধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরবরাহ করা হচ্ছে—এমন তথ্য উঠে এসেছে মানবাধিকার সংগঠন জাস্টিস ফর মিয়ানমার (জেএফএম) এর প্রতিবেদনে।
মিয়ানমারের সামরিক জান্তার জন্য বেলারুশের সমর্থন
বেলারুশের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বেলস্পেৎসভনেশতেকনিকা মিয়ানমারের সামরিক জান্তার জন্য বিশেষভাবে উন্নত ‘ভি৩ডি রাডার প্রযুক্তি’ এবং ভূমি-ভিত্তিক ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণ করছে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে ড্রোন হামলা প্রতিরোধের সক্ষমতা ব্যাপকভাবে বাড়ানো সম্ভব হবে।
জেএফএম জানায়, বেলারুশের সরবরাহকৃত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় রয়েছে ‘প্যানোরামা অটোমেশন’ এবং ‘ভস্টক থ্রিডি রাডার’ প্রযুক্তি, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত করতে সক্ষম। বিশেষ করে, সামরিক জান্তার বিরোধীদের দ্বারা ব্যবহৃত ড্রোন সনাক্তকরণে এই প্রযুক্তিগুলো অত্যন্ত কার্যকর।
সামরিক প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি হস্তান্তর
কেবল অস্ত্র সরবরাহ নয়, মিয়ানমারের সামরিক সদস্যরা বেলারুশের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেটিক্স অ্যান্ড রেডিওইলেকট্রনিকস-এ আধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে। এর মাধ্যমে জান্তার ক্ষমতা বৃদ্ধি ও নেপিডো, মান্দালয়ে অস্ত্র উৎপাদনের কারখানাগুলোতে দক্ষতা বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ চলছে।
জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে বেলারুশের অবস্থান
২০২১ সালে যখন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ মিয়ানমারে অস্ত্র বিক্রি বন্ধের আহ্বান জানায়, বেলারুশ সেই প্রস্তাবের কঠোর বিরোধিতা করে। সাম্প্রতিক সময়ে, ২০২৫ সালের মার্চ মাসে মিয়ানমারের জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইং বেলারুশ সফর করেন এবং গত শুক্রবার পুনরায় মিনস্কে গিয়ে বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কো-র সঙ্গে অস্ত্র ও বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা করেন।
মিন অং হ্লাইং বেলারুশের অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘অপটিক্যাল অ্যান্ড মেকানিক্যাল অর্গানাইজেশন’-এ যান, যা নাইট ভিশন ডিভাইস এবং ভারী ট্রাকের ব্রেক তৈরিতে বিশেষজ্ঞ। একই সময়ে, তিনি সেখানে অধ্যয়নরত মিয়ানমারের সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তিতে দক্ষতা অর্জনের নির্দেশ দেন।
সামরিক গবেষণা ও প্রযুক্তি বিনিময়
জেএফএম জানায়, বেলারুশের সামরিক শিল্প ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইতোমধ্যে মিয়ানমারের বিভিন্ন শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে। বেলারুশের সামরিক প্রকৌশলী ও প্রশিক্ষকরা বারবার মিয়ানমারে সফর করে সামরিক গবেষণা ও প্রযুক্তির উন্নয়নে সহযোগিতা করছে।
নিষেধাজ্ঞার দাবি এবং আন্তর্জাতিক উদ্বেগ
মানবাধিকার সংগঠন জেএফএম অবিলম্বে বেলারুশ ও মিয়ানমারের মধ্যে অস্ত্র ব্যবসা ও সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করার আহ্বান জানিয়েছে। জেএফএম-এর মুখপাত্র ইয়াদানার মাউং বলেন,
“রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনে বেলারুশের সরাসরি সমর্থন বিবেচনায় রেখে, তাদের সঙ্গে মিয়ানমারের সামরিক সহযোগিতা আরও উদ্বেগের বিষয়। জান্তার কাছে অস্ত্র ও প্রযুক্তি সরবরাহ বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা জরুরি।”
কেন গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়?
মিয়ানমারে ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশটি নানা ধরণের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংকটে জর্জরিত। সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিক্ষোভ ও অস্ত্রবিরোধী কার্যক্রম চললেও তারা বেলারুশের সাহায্যে আধুনিক অস্ত্র ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পেয়ে তাদের ক্ষমতা ও দমননীতি জোরদার করছে।
বিশেষ করে ড্রোন ব্যবহার করে বিরোধীদের উপর আক্রমণ ও নজরদারির সুযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো বেলারুশের এই সহযোগিতাকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের পরিপ্রেক্ষিতে অবিলম্বে থামানোর দাবি জানাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও সামনের পদক্ষেপ
বেলারুশ ও মিয়ানমারের এই সামরিক সহযোগিতা বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন ধরনের উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। পশ্চিমা দেশগুলো ইতোমধ্যেই বেলারুশের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, কিন্তু মিয়ানমারের পরিস্থিতি আরও জটিল।
বিশ্ব সম্প্রদায়কে এখনই কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে বেলারুশের অস্ত্র সরবরাহ এবং প্রশিক্ষণ বন্ধ করতে হবে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এই বিষয়ে আরও সুস্পষ্ট নীতি গ্রহণের জন্য চাপ বৃদ্ধি করছে।
সারসংক্ষেপ
- বেলারুশ মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে সরবরাহ করছে আধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও ভূমি-ভিত্তিক ক্ষেপণাস্ত্র।
- মিয়ানমারের সামরিক কর্মকর্তারা বেলারুশের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।
- ২০২১ সালে জাতিসংঘের অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাবে বেলারুশ বিরোধিতা করেছে।
- মিন অং হ্লাইং এর বেলারুশ সফর ও অস্ত্র ব্যবসা নিয়ে আলোচনা।
- মানবাধিকার সংগঠন জেএফএম বেলারুশ-মিয়ানমার সামরিক সহযোগিতায় নিষেধাজ্ঞার দাবি তুলেছে।
- আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বেলারুশের অস্ত্র সরবরাহ বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা জোর দিয়েছে।