বিশ্ব

সমগ্র ইউক্রেন চান পুতিন: আল জাজিরা

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের পুরো ভূখণ্ড রাশিয়ার অংশ করে নেয়ার অভিপ্রায় আবারও প্রকাশ করেছেন। গত ২০ জুন সেন্ট পিটার্সবার্গ ইকোনমিক ফোরামের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে পুতিন বলেন, “রাশিয়ান ও ইউক্রেনীয় জনগণ একই জাতি। এই অর্থে, সমগ্র ইউক্রেন আমাদের।” তিনি আরও বলেন, “যেখানে রাশিয়ান সৈন্য পা রাখে, সেটাই আমাদের।”

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই বক্তব্য শুধু একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন নয়, বরং এটি ইউরোপের নিরাপত্তা কাঠামোর ওপর সরাসরি হুমকি। পুতিনের এধরনের বার্তা ইউরোপীয় নেতাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে এবং ন্যাটো সদস্যরাষ্ট্রগুলো রাশিয়ার এ আগ্রাসী অবস্থানকে সামাল দিতে নতুন সামরিক কৌশল নির্ধারণে ব্যস্ত।

ইউরোপের নতুন সামরিক প্রতিশ্রুতি

রাশিয়ার এমন বক্তব্যের পরপরই ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও কানাডা ইউক্রেনের প্রতি সামরিক সহায়তা আরও জোরদার করার ঘোষণা দিয়েছে। ন্যাটোর মহাসচিব মার্ক রুটে জানিয়েছেন, ২০২৫ সালে ইউরোপীয় দেশগুলো ও কানাডা মিলে ইউক্রেনকে ৩৫ বিলিয়ন ডলার সামরিক সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, এই সহায়তার প্রকৃত অঙ্ক ইতোমধ্যেই ৪০ বিলিয়নের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।

গত বছর ইউক্রেন পুরো বছরে আন্তর্জাতিক সামরিক সহায়তা হিসেবে পেয়েছিল প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছর মাত্র ছয় মাস পার না হতেই সহায়তার অঙ্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছানো ইউরোপীয় দেশগুলোর রাশিয়াকে ঠেকাতে দৃঢ় অবস্থান প্রকাশ করে।

যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিধা এবং ট্রাম্প প্রশাসনের ভূমিকা

এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রশাসনের পরিবর্তন ইউক্রেনের সহায়তা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কিছুটা অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্যাট্রিয়ট মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম কেনার অনুরোধ জানান, যা রাশিয়ার ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন প্রতিহত করতে সক্ষম।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সাড়া আসতে বিলম্ব হয়। অবশেষে মে মাসে ট্রাম্প প্রশাসন ইউক্রেনকে কিছু অস্ত্র সরবরাহ করে। এই বিলম্ব ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা সক্ষমতায় তাৎক্ষণিক প্রভাব ফেলে। ইউরোপীয় সহায়তা এ শূন্যতা আংশিকভাবে পূরণ করলেও বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ সহায়তা ছাড়া রাশিয়ার বিপরীতে ইউক্রেনের যুদ্ধ অনেকটা অসম হবে।

রাশিয়ার যুদ্ধবিরতির শর্ত

রাশিয়া যদিও একাধিকবার ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে আলোচনার সম্ভাবনার কথা বলেছে, কিন্তু তাদের যুদ্ধবিরতির প্রধান শর্ত হলো— ইউক্রেনের মিত্ররা অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করবে। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ শনিবার আবারও এই শর্ত পুনর্ব্যক্ত করেন। এ শর্ত ইউরোপ ও পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ তারা মনে করেন এতে রাশিয়ার আধিপত্য কৌশল আরও উৎসাহিত হবে।

ইউক্রেনের পাল্টা প্রতিক্রিয়া

পুতিনের বক্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রি সিবিহা বলেন, “রাশিয়ান সৈন্য যেখানেই পা রাখে, সেখানেই মৃত্যু, ধ্বংস ও বিপর্যয় নিয়ে আসে।” একইদিনে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলেন, “হ্যাঁ, পুতিন সমগ্র ইউক্রেন চান। কিন্তু তিনি এখানেই থামবেন না। তিনি বেলারুশ, বাল্টিক রাষ্ট্র, মলদোভা, ককেশাস এবং কাজাখস্তান নিয়েও উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করছেন।”

ইউরোপের নিরাপত্তা পরিকল্পনা

জার্মানির সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ডের স্পিগেল সম্প্রতি একটি গোপন সামরিক নথি ফাঁস করেছে, যেখানে জার্মান সেনাবাহিনীর পরিকল্পনাকারীরা রাশিয়াকে একটি “অস্তিত্বের হুমকি” হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ওই নথিতে বলা হয়েছে, “মস্কো ২০৩০ সালের মধ্যে ন্যাটোর সঙ্গে বড় ধরনের যুদ্ধের জন্য সামরিক বাহিনী ও প্রতিরক্ষা খাতকে প্রস্তুত করছে।”

জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিশ মেরৎজ স্বীকার করেছেন যে, ইউরোপ রাশিয়ার আগ্রাসনের প্রতি দীর্ঘদিন উদাসীন ছিল। তিনি বলেন, “আমরা বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোর হুঁশিয়ারিকে বহুদিন উপেক্ষা করেছি। কিন্তু এখন আমাদের ভুল স্বীকার করতে হচ্ছে। এই বাস্তবতা থেকে ফেরার আর কোনো পথ নেই।”

রাশিয়ার সম্প্রসারণবাদ: নতুন করে আতঙ্ক

পুতিনের সাম্প্রতিক বক্তব্য পশ্চিমা বিশ্লেষকদের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। অনেকেই মনে করছেন, রাশিয়ার এই সম্প্রসারণবাদী মনোভাব শুধুমাত্র ইউক্রেনে সীমাবদ্ধ থাকবে না। ইতিহাসবিদ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ১৯৪৫ সালের পর ইউরোপের ভূ-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সবচেয়ে বড় পরীক্ষার মধ্যে পড়েছে।

ন্যাটোর সাবেক উপ-মহাসচিব আলেকজান্ডার ভেরশবও বিবিসিকে বলেন, “পুতিন শুধু ইউক্রেন দখলের চিন্তা করছেন না, তিনি মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ব সোভিয়েত গৌরব ফিরিয়ে আনতে চান।”

আন্তর্জাতিক বার্তা: সমাধানের পথ কোথায়?

এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ব সম্প্রদায় এখন দুটি প্রশ্নের মুখোমুখি:
১. রাশিয়াকে কীভাবে শান্তিপূর্ণ আলোচনার টেবিলে আনা যাবে?
২. ইউক্রেন ও আশেপাশের দেশগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতে কতদূর পর্যন্ত প্রস্তুত বিশ্ব?

বিশ্লেষকরা বলছেন, কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি সমন্বিত প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি বাড়ানো জরুরি। পুতিন যদি ইউক্রেন দখলের মাধ্যমে তার সম্প্রসারণবাদী নীতিকে সামনে এগিয়ে নেন, তবে তা শুধু ইউরোপ নয়, পুরো বিশ্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button