বিশ্ব

রক্ত দিয়েছে, কিন্তু মর্যাদার প্রশ্নে এক ইঞ্চিও ছাড় দেয়নি ইরানিরা: আব্বাস আরাঘচি

ইরানের সাম্প্রতিক যুদ্ধাবস্থায় রক্ত ঝরেছে, পরিবার হারিয়েছে সন্তান, নগরীর পর নগরী হয়েছে ধ্বংসস্তূপ। তবুও জাতির সম্মান, মর্যাদা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এক বিন্দুও পিছু হটেনি ইরানি জনগণ—এমনই দৃঢ় বার্তা দিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি।

শনিবার (২৮ জুন) তেহরানে একটি রাষ্ট্রীয় জানাজা অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন তিনি। ১২ দিনব্যাপী চলমান ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র সংঘাতে নিহত ইরানিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা রক্ত দিয়েছি, কিন্তু সম্মান হারাইনি। আমরা সন্তান হারিয়েছি, কিন্তু আত্মসমর্পণ করিনি। ইরানিরা মাথা উঁচু রেখেই দাঁড়িয়েছে হাজার হাজার টন বোমার নিচে।”

তার এই বক্তব্য মুহূর্তেই সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে আরাঘচির অফিসিয়াল ইনস্টাগ্রাম পোস্টে ব্যবহৃত ভাষা ও আবেগ অনেককেই আন্দোলিত করে। তিনি লেখেন, “এই ক্ষয়ক্ষতি জাতির প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে থাকবে। ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ সম্ভব, কিন্তু একটি জাতির সম্মান একবার ভেঙে গেলে তা আর ফিরিয়ে আনা যায় না।”

রান ও ইসরায়েলের মধ্যে সাম্প্রতিক এই যুদ্ধ শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত একটি গোপন অভিযানের জবাবে। ইরানের বিভিন্ন সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায় পরিচালিত বিমান হামলার পাল্টা জবাবে ইরান মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে তার মিলিশিয়া অংশীদারদের মাধ্যমে বড় ধরনের প্রতিরোধ শুরু করে। এরই অংশ হিসেবে হিজবুল্লাহ, হুথি বিদ্রোহী এবং সিরিয়া ও ইরাকে ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলো সক্রিয়ভাবে হামলায় অংশ নেয়।

যুদ্ধের পটভূমি

তেহরান বলছে, এই যুদ্ধ ছিল জাতির অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই, যেখানে জয় মানে শুধু শত্রুকে প্রতিহত করাই নয়, বরং নিজের ভেতরের শক্তি ও মর্যাদাকে সংহত করাও।

শ্রদ্ধায় তেহরান

রাষ্ট্রীয় জানাজা অনুষ্ঠানে হাজারো মানুষ যোগ দেন। নিহতদের পরিবারের সদস্যরা কান্নায় ভেঙে পড়েন, কিন্তু তাদের চোখেও ছিল গর্বের দীপ্তি। এক শহীদ পিতার কণ্ঠে উঠে আসে দৃঢ়তা, “আমার ছেলে গেছে, কিন্তু সে দেশ রক্ষা করে গিয়েছে। আমি গর্বিত।”

আব্বাস আরাঘচি এই জানাজাকে ‘জাতির আত্মত্যাগের এক অবিস্মরণীয় দিন’ বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, “আজ শুধু শহীদদের দাফন নয়, বরং ইরানিরা তাদের গর্বকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করছে। যুদ্ধ শেষ হলেও এ জাতির প্রতিরোধ চলবে।

মুক্তার মতো জ্বলজ্বল করবে এই যুদ্ধ’

বক্তব্যে আব্বাস আরাঘচি বলেন, “ইরানের ইতিহাসে এই সময়কাল মুক্তার মতো জ্বলজ্বল করে থাকবে। বিশ্ব দেখেছে, একটি জাতি কিভাবে চাপের মুখে মাথা নত না করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। ইরান আজ শুধু মধ্যপ্রাচ্যে নয়, গোটা বিশ্বের সামনে একটি প্রতিরোধের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে।”

তিনি বলেন, এই যুদ্ধ ইরানকে দুর্বল করেনি, বরং বিশ্ববাসীর চোখে ইরান আরও শক্তিশালী ও মর্যাদাশীল হয়ে উঠেছে। “তারা চেয়েছিল আমাদের দমিয়ে রাখতে, কিন্তু আমরা একত্রিত হয়ে তাদের সেই পরিকল্পনায় জল ঢেলে দিয়েছি,”—বলেন তিনি।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে কড়া বার্তা

ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে একাধিকবার যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সমালোচনা উঠে আসে। তিনি বলেন, “তারা ভেবেছিল প্রযুক্তি ও আধুনিক অস্ত্র দিয়ে আমাদের মাটি ছিনিয়ে নেবে, আমাদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেবে। কিন্তু তারা ভুলে গিয়েছিল—এই মাটি শুধুমাত্র ভৌগোলিক নয়, এটি আমাদের আত্মার অংশ।”

আরাঘচি উল্লেখ করেন, “যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের নীতিমালার বিপরীতে দাঁড়িয়ে আমরা আজ প্রমাণ করেছি—একটি জাতি যদি ঐক্যবদ্ধ থাকে, তবে বিশ্বের যেকোনো শক্তিকে প্রতিহত করতে পারে।”

যুদ্ধের পরে ইরানের কৌশল

যদিও এই যুদ্ধ ইরানের জন্য বহু ক্ষতি ডেকে এনেছে—সাংবাদিকদের মতে, অন্তত পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, সহস্রাধিক ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে, যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে—তবুও ইরান সরকার বলছে, তারা এই ধ্বংসাবশেষের মধ্য থেকেই পুনর্জাগরণের সূচনা করবে।

আরাঘচি বলেন, “আমরা শুধু পুনর্গঠন করবো না, বরং আগের চেয়েও উন্নত ও সংগঠিত ইরান গড়বো। আমাদের পররাষ্ট্রনীতিও হবে আরও শক্তিশালী এবং সম্মানজনক।”

তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্দেশে বলেন, “এই যুদ্ধ ছিল আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া। আমরা আত্মরক্ষার অধিকার ব্যবহার করেছি। এখন আমরা চাই, আন্তর্জাতিক মহল সত্যটা উপলব্ধি করুক।”

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ইরান ও ইসরায়েল উভয়ের দিকেই মানবিক সহিংসতার অভিযোগ এনেছে। জাতিসংঘ একটি তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা দিয়েছে, যেখানে এই সংঘাতের পেছনের কারণ, মানবিক ক্ষতি ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তদন্ত করা হবে।

তবে আব্বাস আরাঘচির মতে, “যারা এখন মানবতার কথা বলছেন, তারা যুদ্ধ শুরু হবার আগে কোথায় ছিলেন? যখন আমাদের ঘুমন্ত শহরে বিমান হামলা হচ্ছিল, তখন তাদের বিবেক জাগেনি কেন?”

জাতির ঐক্যই ইরানের আসল শক্তি

শেষ পর্যন্ত আব্বাস আরাঘচির বক্তব্য স্পষ্ট করে দেয়, এই যুদ্ধ ইরানের একটি ঐতিহাসিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার মুহূর্ত। দেশবাসীর দৃঢ়তা, সরকারের রাজনৈতিক কৌশল এবং আঞ্চলিক জোটবদ্ধতা এই প্রতিরোধকে সফল করে তুলেছে।

তিনি বলেন, “আমরা কখনো যুদ্ধ চাইনি, কিন্তু আত্মসমর্পণও করিনি। আমাদের মূল শক্তি অস্ত্র নয়, আমাদের জনগণের সাহস ও আত্মবিশ্বাস।”

উপসংহার

১২ দিনের এই রক্তাক্ত সংঘাত ইরানকে অনেক কিছু শিখিয়েছে, অনেক কিছু দিয়েছে—শোক, ক্ষয়ক্ষতি ও কষ্টের পাশাপাশি দিয়েছে সম্মানের এক অনন্য ইতিহাস। আব্বাস আরাঘচির কণ্ঠে ফুটে উঠেছে সেই গর্ব, সেই প্রতিজ্ঞা—ইরান মাথা নত করেনি, ভবিষ্যতেও করবে না।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button