বিশ্ব

আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে ভিন্ন এক ইরান দেখতে পাবেন খামেনি

ইসরায়েলের সঙ্গে সাম্প্রতিক ১২ দিনের সংঘর্ষ শেষে এক ভিডিওবার্তায় ইরানকে “বিজয়ী” ঘোষণা করেছেন দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। তবে আলোচিত এই বার্তা দেওয়ার সময়ও তিনি ছিলেন জনচক্ষুর আড়ালে, আত্মগোপনে। অনেকের ধারণা, ৮৬ বছর বয়সী এই নেতা বর্তমানে ইসরায়েলের পাল্টা হামলার আশঙ্কায় একটি গোপন বাংকারে অবস্থান করছেন এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তা পর্যন্ত তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না।

এই বাস্তবতা ইঙ্গিত দেয়, ইরান এখন এক ভিন্ন বাস্তবতায় প্রবেশ করেছে। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক অঙ্গনে চাঞ্চল্য বাড়ছে—নিরাপত্তা, নেতৃত্ব এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে জনমনে।

খামেনির আত্মগোপন: একটি কৌশল না দুর্বলতার প্রতিচ্ছবি?

ইসরায়েলের সঙ্গে সাম্প্রতিক সংঘাতে ইরান যে সরাসরি জড়িত ছিল, তা ইসরায়েলি হামলা এবং প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই খামেনির জনসমক্ষে না আসা বা সেনাবাহিনীর সঙ্গে সরাসরি বৈঠকে অংশ না নেওয়া বহু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারিত ভিডিও বার্তায় খামেনি বলেছেন, “ইরান এই যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে এবং ইসরায়েলকে প্রায় চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেওয়া গেছে।” তবে সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাস্তবতা এতটা একপাক্ষিক নয়। তারা মনে করেন, যুদ্ধবিরতি হলেও দুই পক্ষই ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এর মধ্যে ইরানের নেতৃত্ব কাঠামোর স্থিতিশীলতা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে।

যুদ্ধবিরতির পেছনের নাটকীয়তা

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত কার্যকর হলেও এটি যে দীর্ঘমেয়াদে টিকবে, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন আন্তর্জাতিক কূটনীতিকরা। ট্রাম্পের হস্তক্ষেপ একটি নাটকীয় মোড় এনে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু খামেনির আত্মগোপন ইঙ্গিত দিচ্ছে—তাকে এখনও সতর্ক থাকতে বলা হচ্ছে এবং পরিস্থিতি পুরোপুরি শান্ত নয়।

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জানিয়েছে, খামেনির অবস্থান নিয়ে তাদের কাছে নিশ্চিত তথ্য নেই। এমনকি ইরানের অনেক উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা বা শাসকগোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠরাও জানেন না, তিনি ঠিক কোথায় আছেন।

একটি নতুন ইরানের মুখোমুখি খামেনি?

যুদ্ধবিরতির পর যখন ইরান ধীরে ধীরে স্বাভাবিকতায় ফিরছে, তখন খামেনির জন্য অপেক্ষা করছে এক ভিন্ন বাস্তবতা। দেশটির অর্থনীতি আগে থেকেই অব্যবস্থাপনার শিকার, আর এই সামরিক সংঘাত তা আরও দুর্বল করেছে। সাধারণ মানুষ চায় শান্তি, কর্মসংস্থান ও খাদ্যনিরাপত্তা—যা বর্তমানে সংকটাপন্ন।

অন্যদিকে, যুবসমাজ, যারা বিগত কয়েক বছর ধরে সংস্কার ও স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করে আসছে, তাদের বিরুদ্ধচিন্তা নতুন করে সংগঠিত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। অনেকে আশঙ্কা করছেন, সংঘাতের ছত্রছায়ায় সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের পথ বেছে নিতে পারে, যেটি খামেনির ভাবমূর্তিকে আরও ক্ষুণ্ণ করবে।

আন্তর্জাতিক চাপ ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক টানাপোড়েন

ইরান–ইসরায়েল সংঘাত আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, তাতে স্পষ্ট হয়েছে—ইরান ক্রমাগত চাপে রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ ও মার্কিন কংগ্রেস এই সংঘাতের পর ইরানের বিরুদ্ধে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এছাড়া, খোদ ইরানের রাজনৈতিক মহলেও ক্ষমতার ভারসাম্য নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। খামেনির দীর্ঘ অনুপস্থিতি এবং কার্যত রাজনৈতিক নিশ্চুপতা এই প্রশ্ন তুলছে—তার পরবর্তী উত্তরসূরি কে হবেন? এবং আদৌ কি বর্তমান ব্যবস্থার স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব হবে?

‘বিজয়’র মূল্য কতটা?

খামেনি তার ভিডিওবার্তায় ইরানিদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, “আমরা প্রমাণ করেছি, ঈমান ও প্রতিরোধের শক্তি দিয়ে আধুনিক অস্ত্র ও সামরিক বাহিনীকেও পরাজিত করা সম্ভব।” তবে বাস্তবচিত্র অন্য কিছু বলছে।

ইসরায়েলি বোমাবর্ষণে সিরিয়ায় ইরানের একাধিক ঘাঁটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, হিজবুল্লাহর সহযোগিতা সত্ত্বেও দক্ষিণ লেবাননে নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়েছে এবং ইয়েমেনে হুথিদের মধ্যে হতাশা ছড়িয়ে পড়েছে। এই ‘বিজয়’ যে কেবল প্রতীকী তা অস্বীকার করা কঠিন।

ভবিষ্যতের পথে: নেতৃত্বের পরিবর্তন কি অবশ্যম্ভাবী?

অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, খামেনির বয়স ও স্বাস্থ্যগত অবস্থা বিবেচনায় এটাই হতে পারে তার সর্বশেষ বড় মাপের সামরিক উত্তেজনা। যুদ্ধবিরতির পরে যদি তিনি আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে আসেন, তাহলে তাকে এমন এক ইরানের নেতৃত্ব দিতে হবে, যেটি আগের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতবিক্ষত, হতাশ ও অর্থনৈতিকভাবে নাজুক।

আর যদি তিনি দীর্ঘ সময়ের জন্য অদৃশ্য থাকেন, তবে তা ইরানে ক্ষমতার শূন্যতা সৃষ্টি করবে—যার পরিণতি অনিশ্চিত এবং হয়তো রক্তক্ষয়ীও হতে পারে।

কথা

আত্মগোপনে থাকা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির “বিজয় ঘোষণার” সময় যতটা আত্মবিশ্বাস ছড়ানো হয়েছে, বাস্তবতা তার চেয়ে অনেক জটিল। ইরান এখন যে পরিস্থিতির মুখোমুখি, তা শুধু একটি যুদ্ধের শেষ নয়—এটি একটি রাজনৈতিক যুগের শেষের ঘণ্টাও বয়ে আনতে পারে।

এই সংকটের মাঝেই খামেনিকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং দেশকে নতুনভাবে সংগঠিত করতে হবে। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, তিনি কি প্রস্তুত সেই বাস্তবতা মোকাবিলা করার জন্য?

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button