পাকিস্তানে আকস্মিক বন্যায় নিখোঁজ ১৮, আটজনের মরদেহ উদ্ধার

পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে আকস্মিক বন্যায় একই পরিবারের অন্তত ১৮ জন সদস্য ভেসে যাওয়ার ঘটনায় দেশজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। ভয়াবহ এই ঘটনার পর থেকে এখন পর্যন্ত আটজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে এবং তিনজনকে জীবিত অবস্থায় পাওয়া গেছে। নিখোঁজদের উদ্ধারে এখনও তীব্রভাবে উদ্ধার অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন ও রেসকিউ টিমগুলো।
সোয়াত নদীর পাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে গিয়ে এমন মর্মান্তিক ঘটনার শিকার হয়েছে শিয়ালকোট থেকে আগত একটি পরিবার। শুক্রবার (২৭ জুন) সকাল ৮টার দিকে তারা নদীর তীরে বসে সকালের নাস্তা করছিলেন। ঠিক সেই সময় হঠাৎ করে উজান থেকে প্রচণ্ড পানির ঢল নেমে আসে। নদীতে পানির স্তর অতি দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে পুরো এলাকা প্লাবিত হয়ে যায়। স্থানীয়রা জানান, এমন আকস্মিক স্রোতে পরিবারটির অধিকাংশ সদস্য কোনো প্রতিক্রিয়া জানানোর আগেই নদীর প্রবল স্রোতে তলিয়ে যান।
আকস্মিক বন্যার পেছনের কারণ
পাকিস্তানের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম জিও নিউজ জানায়, সোয়াত নদীর তীরবর্তী অঞ্চলজুড়ে গত কয়েকদিন ধরেই ভারী বর্ষণ চলছিল। শুক্রবার ভোর থেকে পাহাড়ি এলাকায় লাগাতার বৃষ্টিপাত হওয়ায় নদীতে পানির স্তর বিপজ্জনকভাবে বেড়ে যায়। খাইবার পাখতুনখোয়ার জরুরি সেবা সংস্থা ‘রেসকিউ ১১২২’-এর এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, একাধিক পাহাড়ি স্রোত একত্রিত হয়ে এই আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি করে।
নিহত ও নিখোঁজদের পরিচয়
প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, নিহত ও নিখোঁজ সবাই একই পরিবারের সদস্য। তারা সবাই শিয়ালকোট শহর থেকে বেড়াতে এসেছিলেন। এই পরিবারের সদস্যরা ৪ থেকে ৬৫ বছর বয়সী। উদ্ধারকৃত আটটি মরদেহ ইতোমধ্যে নিকটস্থ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তাদের মধ্যে চারজন নারী ও দুইজন শিশু রয়েছে বলে উদ্ধারকর্মীরা নিশ্চিত করেছেন।
প্রাদেশিক মুখ্য সচিব শাহাব আলী শাহ জানান, নিখোঁজ ১৮ জনের মধ্যে এখনও সাতজনের কোনো খোঁজ মেলেনি। উদ্ধারে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও বেসামরিক স্বেচ্ছাসেবীদের সমন্বয়ে গঠিত টিম কাজ করছে। সোয়াত জেলার আটটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। একইসঙ্গে নদীর প্রবাহের নিচের দিকে নজর রাখা হচ্ছে, যাতে করে ভেসে যাওয়া ব্যক্তিদের শনাক্ত করা যায়।
উদ্ধার কার্যক্রম ও সরকারিভাবে উদ্যোগ
খাইবার পাখতুনখোয়া সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত উদ্ধার তৎপরতা শুরু করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রাদেশিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ (পিডিএমএ) ও স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয়ে ঘটনাস্থলে উদ্ধারকারী দল মোতায়েন করা হয়েছে। এ পর্যন্ত সোয়াত নদীর বাইপাস সড়কের পাশে ৭৫ জন আটকে পড়েছিলেন, যাদের মধ্যে ৫৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি ১৭ জনকে উদ্ধারে চেষ্টা চলছে।
সরকারিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সাহায্য করার জন্য জরুরি ত্রাণ বরাদ্দের ঘোষণাও এসেছে। খাদ্য, ওষুধ, শুকনো খাবার এবং আশ্রয়ের জন্য তাঁবু সরবরাহের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি নিখোঁজদের পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
অতীতের অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যৎ সতর্কতা
পাকিস্তানে আকস্মিক বন্যা নতুন কিছু নয়। প্রতিবছরই বর্ষা মৌসুমে দেশটির পাহাড়ি ও নদীঘেঁষা অঞ্চলগুলোতে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। ২০২২ সালে দেশটির সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে আকস্মিক বন্যায় প্রাণ হারিয়েছিল প্রায় ১৭০০ জনেরও বেশি মানুষ। সেই অভিজ্ঞতার পরও পর্যাপ্ত আগাম সতর্কতা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না থাকায় এমন দুর্ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আবহাওয়ার অগ্রিম পূর্বাভাস থাকলেও সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা গড়ে না ওঠা এবং দুর্বল অবকাঠামো ব্যবস্থা এসব প্রাণহানির অন্যতম কারণ। বিশেষ করে পর্যটন এলাকায় আগাম সতর্ক সংকেত বা নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় স্থানীয় ও ভ্রমণকারী উভয়েই ঝুঁকিতে থাকেন।
পাঞ্জাবেও প্রাণহানি
এদিকে, বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশেও ভারী মৌসুমি বৃষ্টির কারণে বাড়ি ধসে এবং বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে অন্তত ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বহু ঘরবাড়ি ও দোকানপাট। অনেক জায়গায় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বিদ্যুৎ ও পানির সঙ্কটে পড়েছেন হাজার হাজার মানুষ।
পাকিস্তানের আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, আগামী কয়েকদিন ধরে আরও ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। তাই দেশের উত্তরের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যার সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
সমাপ্তি
এই দুর্ঘটনা শুধু একটি পরিবারের জন্য নয়, বরং গোটা পাকিস্তানের জন্য একটি কঠিন এবং বেদনাদায়ক স্মৃতি হয়ে রইল। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করতে হলে আরও বেশি সচেতনতা, প্রযুক্তিনির্ভর পূর্বাভাস ব্যবস্থা এবং বাস্তবভিত্তিক উদ্ধার কৌশল জরুরি হয়ে পড়েছে। শুধু মাত্র উদ্ধার নয়, বন্যার ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে স্থায়ী নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তুলতেই হবে, যেন ভবিষ্যতে এ ধরনের হৃদয়বিদারক ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।