ইরান অস্ত্র তৈরির মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করলে আবার হামলা: ট্রাম্প

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ফের ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক হামলার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তাঁর ভাষায়, ইরান যদি অস্ত্র তৈরির মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হয়, তাহলে তিনি দ্বিতীয় দফায় তেহরানের পরমাণু স্থাপনায় বোমা বর্ষণের আদেশ দিতে একটুও দ্বিধা করবেন না। হোয়াইট হাউসে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প বলেন, “এটি প্রশ্নাতীত—ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর পথে আগালে আবারও হামলা হবে।”
এই হুঁশিয়ারি এমন এক সময়ে এলো, যখন ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে টানা ১২ দিনের সামরিক সংঘাত থেমেছে মাত্র পাঁচ দিন আগে। ২৩ জুন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ঘোষিত যুদ্ধবিরতির পরও উত্তেজনা পুরোপুরি প্রশমিত হয়নি। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষকরা বলছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই বক্তব্য ইরানকে ফের চাপে ফেলতে এবং পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য জোরালো করতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
ট্রাম্পের ভাষ্য: ‘আবার হামলা হবে, নিশ্চয়ই’
ট্রাম্প বলেন, “২১ জুন যেভাবে ইরানের তিনটি পরমাণু স্থাপনায় সফলভাবে হামলা চালানো হয়েছিল, ভবিষ্যতেও তা হতে পারে। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ অস্ত্র তৈরির পর্যায়ে পৌঁছালে সেটা যুক্তরাষ্ট্রের সহ্যসীমার বাইরে।” সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, “আমার দায়িত্ব আমেরিকানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ইরানের হাতে যদি পারমাণবিক অস্ত্র চলে যায়, সেটি হবে ভয়ঙ্কর পরিণতির সূচনা।”
তিনি দাবি করেন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি সাম্প্রতিক সংঘাতে ‘বাজেভাবে মার খেয়েছেন’। ট্রাম্পের ভাষ্য অনুযায়ী, “তাঁর পরিকল্পনাগুলো ভেস্তে গেছে। আমাদের লক্ষ্য ছিল বার্তা দেওয়া—যদি পারমাণবিক অস্ত্রে এগোনো হয়, তাহলে তা থামিয়ে দেওয়া হবে।”
২১ জুনের হামলা: যুক্তরাষ্ট্রের ‘সফল’ অপারেশন
ট্রাম্পের নির্দেশে যুক্তরাষ্ট্র ২১ জুন ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এগুলো হলো—ফর্দো, নাতাঞ্জ এবং ইসফাহান। ট্রাম্প দাবি করেন, এই তিনটি কেন্দ্র পুরোপুরি ধ্বংস করা হয়েছে।
হামলায় ব্যবহৃত হয় বি-২ স্টেলথ বোমারু বিমান এবং টমাহক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, যেগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সাবমেরিন থেকে ছোড়া হয়। এই অভিযানে মানুষের হতাহতের নির্দিষ্ট সংখ্যা না জানালেও ট্রাম্প বলেন, ‘নির্বাচিত ও নির্ভুল’ হামলার মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি সীমিত রাখা হয়েছে।
ইসরায়েল-ইরান সংঘাত: উত্তাপের পেছনের গল্প
এ সংঘাতের সূত্রপাত ১৩ জুন, যখন ইসরায়েল ইরানের সামরিক স্থাপনায় হামলা চালায়। তাদের দাবি ছিল, ইরান গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যা বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি। এরপর টানা ১২ দিন দুই দেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা হয়।
এই সময়ে ইরানও পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ইসরায়েলি স্থাপনায় আঘাত হানে। নিহত হন উভয় পক্ষের সামরিক কর্মকর্তা ও বেসামরিক নাগরিক। অবশেষে ২৩ জুন যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় কূটনৈতিক উদ্যোগে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়।
ট্রাম্প বলেন, “২৩ জুন যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে সংঘাত থামানোই ছিল সঠিক পদক্ষেপ। তবে ইরান যদি পরমাণু কার্যক্রমে ফের সক্রিয় হয়, তাহলে আরেক দফা পদক্ষেপ নিতে আমরা প্রস্তুত।”
ইরানের প্রতিক্রিয়া: আত্মরক্ষার অঙ্গীকার
এদিকে ইরানের পক্ষ থেকে ট্রাম্পের হুমকির তীব্র প্রতিবাদ এসেছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, “ইরান সবসময় শান্তিপূর্ণ পরমাণু প্রযুক্তির পক্ষে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে আক্রমণ করছে।” তাঁরা এটিকে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছেন।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) দীর্ঘদিন ধরে পর্যবেক্ষণ চালিয়ে আসছে। ইরানের দাবি, তাদের কার্যক্রম সেই সংস্থার নিয়ম অনুযায়ীই চলছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল: ইরানকে একঘরে করার প্রয়াস?
বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের কৌশল হলো ইরানকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একঘরে করা। তার জন্য সামরিক চাপ, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এবং কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা—এই তিনটি স্তরেই পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে বর্তমানে ইরানবিরোধী অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়েছে। রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট উভয় দলই মনে করছেন, ইরানকে দমন করতে আরও ‘আগ্রাসী’ কৌশল নেওয়া উচিত।
মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধির আশঙ্কা
এই পরিস্থিতিতে নতুন করে হামলা চালানোর হুমকি আবারও মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা বাড়িয়ে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষ করে সিরিয়া, লেবানন, ইয়েমেনসহ ইরানের মিত্র দেশগুলোতে প্রতিক্রিয়া আরও জোরালো হতে পারে।
বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলছেন, যুদ্ধবিরতির পর হঠাৎ করে এমন হুমকি দিয়ে তেহরানকে চাপে ফেললে শান্তিচেষ্টা ব্যাহত হতে পারে। একইসঙ্গে এটি আন্তর্জাতিক পরমাণু সমঝোতার (JCPOA) ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিতে পারে।
পরমাণু অস্ত্র ইস্যুতে তেহরান: বরাবরের অস্বীকার
ইরান দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছে, তাদের পরমাণু প্রকল্প শান্তিপূর্ণ। ২০১৫ সালে করা চুক্তি অনুযায়ী (যা পরবর্তীতে ট্রাম্প ২০১৮ সালে বাতিল করেন), ইরান তাদের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম সীমিত করেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তি থেকে সরে আসার পর তেহরান আবার কার্যক্রম জোরদার করে।
তবে ইরান এখনো দাবি করে, তারা অস্ত্র বানানোর মতো মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে না। আইএইএ গত মাসে জানায়, ইরানের কিছু স্থানে ৬০ শতাংশ মাত্রার ইউরেনিয়াম পাওয়া গেছে, যা অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ৯০ শতাংশের কাছাকাছি।
উপসংহার
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই সর্বশেষ হুঁশিয়ারি বিশ্ব রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাক্কালে এই কড়া ভাষায় বার্তা দেওয়ার মাধ্যমে তিনি নিজের পররাষ্ট্রনীতির কঠোর অবস্থান আবারও প্রকাশ করলেন। তবে বিষয়টি কেবল ইরানকে নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্য ও আন্তর্জাতিক পরমাণু নিরাপত্তা ব্যবস্থাকেই এক নতুন পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।