বিশ্ব

ইরানে হামলার প্রস্তুতি চলছিল বহু বছর ধরে!

 ইরানে সম্প্রতি ইসরায়েল যে ভয়াবহ সামরিক অভিযান চালিয়েছে, তা কোনো হঠাৎ নেওয়া সিদ্ধান্ত ছিল না। বরং বছরের পর বছর ধরে পরিকল্পিত ও সুদূরপ্রসারী এক প্রস্তুতির ফসল এই হামলা। ১৩ জুন ভোররাতে শুরু হয়ে টানা ১২ দিন ধরে চলে এই অপারেশন — যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’।

এই অভিযানে প্রাণ হারিয়েছেন ইরানের সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের অন্তত ২০ জন কমান্ডার, কয়েকজন পরমাণু বিজ্ঞানী এবং সাধারণ নাগরিকসহ প্রায় ৮০০ মানুষ। বিশ্বের নজর এখন এই ঘটনাপ্রবাহে — কেননা এই অভিযানের পেছনের ছায়াযুদ্ধ, গুপ্তচরবৃত্তি এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি নতুন করে উদ্বেগ ছড়িয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে।

বহু বছরের পরিকল্পনা: ইসরায়েলি পাইলটের বয়ান প্রকাশ্যে

ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর এক রিজার্ভ পাইলট সম্প্রতি স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে জানান, এই মিশনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল ইসরায়েল বহু বছর আগে থেকেই। পাইলটের নাম পরিচয় গোপন রাখা হলেও, তার অভিজ্ঞতা বর্ণনায় উঠে এসেছে এক নাটকীয় বাস্তবতা।

তিনি বলেন, “অভিযান শুরু হওয়ার আগের রাতে আমি একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে ছিলাম। হঠাৎ স্কোয়াড্রনে রিপোর্ট করার বার্তা আসে। কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে আমাকে চুপিচুপি প্রস্তুতি নিতে হয়।”

তিনি আরও জানান, ইরানের রাজধানী তেহরানে বোমা বর্ষণের সময় আকাশ থেকে শহরটিকে একদম নীরব মনে হচ্ছিল, যেন যুদ্ধের আতঙ্ক তার নিঃশব্দ রূপে বিরাজ করছে।

ইরানের ভেতরে বিস্ফোরক-ভিত্তিক ড্রোন কারখানা!

এই অভিযানের সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক হলো ইসরায়েলের গোপন গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সরাসরি ভূমিকা। আল জাজিরার মতে, ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরেই ইরানের অভ্যন্তরে ছোট ড্রোন উৎপাদনের কারখানা তৈরি করছিল। ছদ্মবেশী পোশাক ও উচ্চপ্রযুক্তি সরঞ্জাম নিয়ে তারা ইরানের মরুভূমি এলাকায় ঘাঁটি গড়ে।

তাদের লক্ষ্য ছিল ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল করে দেওয়া, যাতে ইসরায়েলের যুদ্ধবিমানগুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে হামলা চালাতে পারে। স্পাইক মিসাইল, কোয়াডকপ্টার ড্রোন ও দূরনিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরকযন্ত্র ব্যবহার করে এসব ঘাঁটিগুলোতে আঘাত হানা হয়।

আকাশ থেকে মিসাইল, মাটিতে গুপ্তচর: ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় বড় ফাঁক

ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা এই হামলায় নগ্ন হয়ে পড়েছে। ইসরায়েল এমনকি ছোট ট্রাকে বসানো ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ যন্ত্র, দূরনিয়ন্ত্রিত অস্ত্র এবং ইন্টারনেটভিত্তিক হ্যাকিং প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে।

ইরান সরকারের দাবি, তারা বেশ কয়েকটি ছোট ড্রোন ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে। তবে বড় ধরণের ক্ষতি তারা ঠেকাতে পারেনি। ইসরায়েল দাবি করেছে, তেহরানসহ বিভিন্ন এলাকায় তাদের স্থাপন করা ড্রোন ঘাঁটিগুলো হামলার বড় ভূমিকা রেখেছে।

ব্যাংক ও ইন্টারনেট পরিষেবা অচল

শুধু সামরিক হামলাতেই থেমে থাকেনি ইসরায়েলের অভিযান। সাইবার ফ্রন্টেও একাধিক হামলা চালানো হয়। ইরানের দুটি বড় ব্যাংক এবং একটি ক্রিপ্টো এক্সচেঞ্জ এক পর্যায়ে অচল হয়ে পড়ে।

ইরানের শীর্ষ মহাকাশ কমান্ডার আমির আলী হাজিজাদেহ এক ভিডিও বার্তায় অভিযোগ করেন, মোসাদ তাদের মোবাইল ফোন, স্যাটেলাইট সংযোগ ও অন্যান্য ডিভাইসের মাধ্যমে নিরবিচারে নজরদারি করছে। এই বক্তব্য দেওয়ার কিছু সময় পরই তিনি নিহত হন এক বিমান হামলায়।

ইসরায়েলের বার্তা: “আমরা শান্তির বিরুদ্ধে নই, হুমকির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি”

ইসরায়েলের এক পাইলট বলেন, “আমরা ইরানের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি না। আমরা তাদের বিরুদ্ধে আঘাত করেছি, যারা আমাদের ধ্বংস করতে চায়। শান্তি একদিন আসবে — আমরা একসঙ্গে উন্নতি করব।”

এই বক্তব্যে হয়তো একটি কূটনৈতিক বার্তা রয়েছে, কিন্তু বাস্তবতা হলো এই সংঘর্ষে মধ্যপ্রাচ্যে আবারও উত্তেজনা চরমে উঠেছে।

কী বার্তা দিচ্ছে এই হামলা?

বিশ্ব রাজনীতিবিদরা বলছেন, ইরানে ইসরায়েলের এই আগ্রাসনমূলক হামলা শুধু একটি সামরিক সফলতা নয়, বরং এটি মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতির চিত্র পাল্টে দেওয়ার একটি পদক্ষেপ। ইরান, ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও আরব দেশগুলোর জটিল সম্পর্কের মধ্যে এই হামলা নতুন মোড় তৈরি করেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অপারেশনের মাধ্যমে ইসরায়েল বিশ্বের কাছে দেখাতে চায়, তাদের প্রযুক্তিগত ও গোয়েন্দা সক্ষমতা কতটা ভয়ঙ্কর মাত্রায় পৌঁছেছে।

শেষ কথা

এই মুহূর্তে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধ না হলেও, ছায়াযুদ্ধের পরিসর দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিশ্বের প্রতিটি কূটনৈতিক মহলই এখন এই অঞ্চলের দিকে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে। আর এর পেছনে রয়েছে সেই বহু বছর ধরে চলা প্রস্তুতির এক ভয়াল বাস্তব রূপ — যা রক্তাক্ত করেছে তেহরানের আকাশ।
এম আর এম – ০০৭৫, Signalbd.com

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button