ইসরায়েল নিজেই পরমাণু অস্ত্র বানাতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে বারবার ধোঁকা দিয়েছিল

বিশ্ব রাজনীতিতে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে দুশ্চিন্তা পুরোনো ঘটনা। ২০০২ সালে তেহরানের গোপন ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছে—ইরানকে কোনোভাবেই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে দেওয়া যাবে না। কিন্তু এই সতর্কবার্তার পেছনে যে রাষ্ট্র সবচেয়ে সরব, সেই ইসরায়েলই ছিল ইতিহাসের এক বড় পরমাণু প্রতারণার কেন্দ্রে। শুধু বৈশ্বিক সম্প্রদায়কেই নয়, তাদের সবচেয়ে বড় মিত্র যুক্তরাষ্ট্রকেও বহুবার ধোঁকা দিয়েছে তেলআবিব।
যুক্তরাষ্ট্রের কড়া বার্তা ইরানকে
ইরান যাতে পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত হতে না পারে—এটাই ছিল একের পর এক মার্কিন প্রেসিডেন্টের অঙ্গীকার। প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ থেকে ওবামা এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প পর্যন্ত প্রত্যেকে ইরানকে এই ইস্যুতে রাশ টানার বার্তা দিয়েছেন। ২০২৫ সালের ১৭ জুন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, “ইরান কোনোভাবেই পারমাণবিক অস্ত্র পেতে পারবে না… এতে আর গভীরে যাওয়ার দরকার নেই।”
অথচ ইরান ১৯৭০ সাল থেকেই পরমাণু অস্ত্র বিস্তাররোধ চুক্তি (NPT)-এর সদস্য। এই চুক্তির আওতায় তারা আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের অধীনে শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। ২০১৫ সালে ছয় বিশ্বশক্তির সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে ইরান কার্যত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি না করার স্থায়ী অঙ্গীকার করেছিল। যদিও ২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসন সেই চুক্তি থেকে সরে আসে।
অন্যদিকে ইসরায়েলের গোপন কর্মসূচি
ইরানকে যেখানে প্রতিনিয়ত নজরদারিতে রাখা হয়, সেখানে ইসরায়েল একটি ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছিল—সম্পূর্ণ গোপনীয়তা, অস্বীকার এবং ধোঁকাবাজি। ১৯৫০-এর দশকের মাঝামাঝি ইসরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিয়নই প্রথম পারমাণবিক শক্তিকে ‘জাতীয় অস্তিত্বের বীমা’ হিসেবে বিবেচনা করেন। সেই সময় থেকেই শুরু হয় ইসরায়েলের গোপন কর্মযজ্ঞ।
ডিমোনা চুল্লি ও প্রতারণার সূচনা
১৯৫৬ সালের সুয়েজ সংকটের পর ফ্রান্স ইসরায়েলের সঙ্গে গোপন চুক্তি করে, যার আওতায় নেগেভ মরুভূমিতে ডিমোনা পারমাণবিক স্থাপনা নির্মিত হয়। একই সময় নরওয়ে সরবরাহ করে ভারী পানি, যা একটি চুল্লিতে পারমাণবিক বিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। তবে এইসব সহায়তার জন্য ইসরায়েল দাবি করেছিল, তাদের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ। অথচ বাস্তবে তারা একটি পূর্ণমাত্রার পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি গড়ে তোলে।
১৯৫৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দারা ডিমোনা চুল্লি সম্পর্কে জানতে পারে। ইসরায়েল প্রথমে বলে, এটি একটি টেক্সটাইল কারখানা। পরে আবার জানায়, এটি ধাতুবিদ্যার গবেষণাগার। এমনকি মার্কিন প্রতিনিধিদলের জন্য তৈরি করা হয় ভুয়া নিয়ন্ত্রণকক্ষ। সেখানে থাকত ভুয়া পরিমাপ যন্ত্র, কম্পিউটার ডিসপ্লে এবং জাল বোর্ড—সবই মার্কিন পরিদর্শকদের বিভ্রান্ত করার জন্য।
কেনেডি ও নিখুঁত প্রতিরোধ
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ইসরায়েলের এ ধরনের গোপন প্রকল্প নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। ১৯৬৩ সালে তিনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী লেভি ইশকোলকে একটি কড়া বার্তা পাঠান: যদি পরমাণু কর্মসূচি সম্পর্কে যথাযথ তথ্য না দেওয়া হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সম্পর্ক গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ইশকোল পাল্টা জবাবে বলেন, ইসরায়েলের কর্মসূচি শুধুই গবেষণামূলক। তবে মার্কিন প্রতিনিধিদল বুঝতে পারেনি, ভূগর্ভস্থ প্লুটোনিয়াম পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ প্ল্যান্ট ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। একে লুকাতে ইসরায়েল স্থাপনার ভেতরে তৈরি করেছিল ভিন্ন রুট এবং দেয়ালের আড়ালে সুরক্ষিত প্রবেশপথ।
১৯৬৯ সালের গোপন সমঝোতা
১৯৬৮ সালে সিআইএ নিশ্চিত হয়, ইসরায়েলের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। এই খবরের পর ১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ারের মধ্যে একটি গোপন চুক্তি হয়। এতে যুক্তরাষ্ট্র রাজি হয়, ইসরায়েলের অস্ত্রভাণ্ডার বিষয়ে তারা চাপ দেবে না। শর্ত ছিল—ইসরায়েল পারমাণবিক অস্ত্রের কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করবে না এবং কোনো পরীক্ষাও চালাবে না।
এই সমঝোতায় মধ্যপ্রাচ্যের ‘পূর্বপরিকল্পিত পরমাণু ভারসাম্য’ রক্ষা করার নামে ইসরায়েলের প্রতারণাকে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল।
ভেলা উপগ্রহ ও গোপন বিস্ফোরণ
১৯৭৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একটি উপগ্রহ (ভেলা ৬৯১১) দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলে একটি অস্বাভাবিক বিস্ফোরণ সনাক্ত করে, যা পরমাণু বিস্ফোরণের বৈশিষ্ট্য বহন করে। সন্দেহের আঙুল ওঠে ইসরায়েল ও দক্ষিণ আফ্রিকার দিকে। যদিও ইসরায়েল কখনোই স্বীকার করেনি যে তারা কোনো পরীক্ষা চালিয়েছে। ২০১১ সালে কংগ্রেসের সাবেক সহকারী লিওনার্ড ওয়েইস জানান, ওই বিস্ফোরণ ছিল ইসরায়েল-দক্ষিণ আফ্রিকার যৌথ পারমাণবিক পরীক্ষা—এর পক্ষে প্রমাণ এতটাই জোরালো যে অস্বীকার করা কঠিন।
পারমাণবিক অস্ত্র কতগুলো?
ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্টসের তথ্যমতে, ২০২১ সাল পর্যন্ত ইসরায়েলের কাছে প্রায় ৯০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে। এসব অস্ত্র বিমান, ক্ষেপণাস্ত্র এমনকি সাবমেরিন থেকেও ছোঁড়া সম্ভব। তবে এখন পর্যন্ত ইসরায়েল আনুষ্ঠানিকভাবে কখনো পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ বলে নিজেদের ঘোষণা দেয়নি।
বৈষম্যমূলক নীতি: ইরান বনাম ইসরায়েল
ইসরায়েলের এই গোপন অস্ত্রভাণ্ডার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা জাতিসংঘ কখনোই জোরালো অবস্থান নেয়নি। অথচ ইরান যখন শান্তিপূর্ণ চুল্লি নির্মাণ বা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার ঘোষণা দেয়, তখনই তার বিরুদ্ধে একগুচ্ছ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও তার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বরাবরই নমনীয়।
বিশ্লেষকদের মতে, এই বৈষম্যমূলক নীতি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের নৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এ কারণেই অনেক সময় ইরান, সৌদি আরব বা অন্যান্য দেশ যুক্তরাষ্ট্রের ‘দ্বিমুখী’ নীতি নিয়ে আপত্তি তোলে।
পরিশেষ
ইসরায়েল তার অস্তিত্ব রক্ষার যুক্তিতে পারমাণবিক কর্মসূচিকে ঢাল বানিয়েছে। কিন্তু এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ প্রতারণা, ধোঁকা এবং কৌশলী কূটনীতি। তারা শুধু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেই নয়, তাদের সবচেয়ে বড় মিত্র যুক্তরাষ্ট্রকেও দীর্ঘদিন ধরে অন্ধকারে রেখেছিল।
অন্যদিকে ইরান আজ এমন এক ভূরাজনৈতিক অঞ্চলে রয়েছে, যার চারপাশে রাশিয়া, পাকিস্তান, ভারত এবং ইসরায়েলের মতো পারমাণবিক শক্তিধর দেশ ঘিরে আছে। এই প্রেক্ষাপটে ইরান নিজেদের ‘পারমাণবিক বিমা’ চাইলে, সেটিও এক ধরনের নিরাপত্তা-মনস্তত্ত্বের প্রকাশ।
ইসরায়েলের পরমাণু অস্ত্রের এই ইতিহাস কেবল মধ্যপ্রাচ্যের সামরিক ভারসাম্যই বদলেছে না, বিশ্ব কূটনীতির নৈতিক দ্বিচারিতাকেও উন্মোচন করেছে।