বিশ্ব

গাজায় চিকিৎসা সহায়তা পৌঁছালেও ‘সমুদ্রে এক ফোঁটা’ বলছে ডব্লিউএইচও

 প্রায় তিন মাস পর গাজায় ঢুকল ৯টি ট্রাকের চিকিৎসা সহায়তা। তবুও প্রয়োজনের তুলনায় এটি সামান্য। শত শত আহত, অপুষ্ট শিশু ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দাবি—‘এই সহায়তা যথেষ্ট নয়’।

গাজা উপত্যকায় দীর্ঘ অবরোধ শেষে অবশেষে কিছু চিকিৎসা সহায়তা প্রবেশের অনুমতি মিলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জানিয়েছে, ৯টি ট্রাকে করে পাঠানো এই সহায়তা গাজার কিছু হাসপাতালের হাতে পৌঁছেছে। তবে সংস্থাটির মতে, এই সহায়তা প্রয়োজনের তুলনায় ‘সমুদ্রে এক ফোঁটা’ মাত্র।

চিকিৎসা সহায়তার বিস্তারিত

গত বুধবার কেরেম শালোম সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ইসরায়েলের মাধ্যমে গাজায় প্রবেশ করে ডব্লিউএইচও’র এই চিকিৎসা সরঞ্জাম। সহায়তার মধ্যে রয়েছে প্রায় ২০০০ ইউনিট রক্ত, ১৫০০ ইউনিট প্লাজমা ও জরুরি চিকিৎসা সামগ্রী। সংস্থাটির মহাপরিচালক টেড্রোস আধানম গেব্রিয়েসাস জানান, এসব সামগ্রী কয়েক দিনের মধ্যে গাজার বিভিন্ন অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া হবে।

তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, “এই পরিমাণ সহায়তা দিয়ে গাজার বাস্তবতা সামাল দেওয়া অসম্ভব। মানুষের জীবন বাঁচাতে আরও বড় পরিসরে এবং ধারাবাহিক সহায়তা প্রয়োজন।”

যুদ্ধ ও অবরোধের গাজা

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধের পর ইসরায়েল উপত্যকাটিতে কঠোর অবরোধ আরোপ করে। মার্চ ২০২৫ থেকে প্রায় দুই মাস ধরে পুরোপুরি বন্ধ ছিল খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানি সরবরাহ। মে মাসের শেষে কিছু খাদ্যসামগ্রী প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হলেও চিকিৎসা সরঞ্জামের প্রবেশ ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

গাজার হাসপাতালগুলোর মধ্যে প্রায় ৯৪ শতাংশ পুরোপুরি কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে বা সীমিত আকারে চলছে। নাসের মেডিক্যাল কমপ্লেক্স এবং আল শিফা হাসপাতালের মতো কিছু প্রতিষ্ঠান কোনওভাবে চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

গাজার হাসপাতাল ও শিশুদের সংকট

ডব্লিউএইচও জানিয়েছে, গাজার হাসপাতালগুলোর মধ্যে এখন কেবল ১৭টি কোনোভাবে কার্যকর রয়েছে। বিশেষ করে নবজাতক ও শিশুদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। খাদ্য সংকট ও পুষ্টিহীনতার কারণে অনেক মায়ের বুকের দুধ বন্ধ হয়ে গেছে।

নাসের হাসপাতালে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাবে ইতোমধ্যে ৬০টিরও বেশি নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে। ‘বেবি ফর্মুলা ওয়ান ও টু’র অভাবে ১০ হাজারেরও বেশি শিশু শ্বাসকষ্ট ও পরিপাকতন্ত্রজনিত সমস্যায় ভুগছে।

গাজায় চিকিৎসা সরঞ্জাম না থাকায় প্রাথমিক চিকিৎসাও দিতে পারছে না হাসপাতালগুলো। প্রতি দিন ত্রাণ নিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ বা আহত হচ্ছেন বহু মানুষ, কিন্তু তাদের জন্যও নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসা।

ডব্লিউএইচও’র বার্তা ও পরিসংখ্যান

টেড্রোস আধানম বলেন, “গাজায় যে সহায়তা পাঠানো হয়েছে তা বাস্তবতার তুলনায় খুবই অপ্রতুল। আমরা চাই, সকল সম্ভাব্য রুট ব্যবহার করে বাধাহীন ও ধারাবাহিক চিকিৎসা সহায়তা পৌঁছানো হোক।”

বর্তমানে গাজার ৩৬টি হাসপাতালের মধ্যে মাত্র ১৭টি আংশিকভাবে সচল। অবশিষ্ট হাসপাতালগুলো চিকিৎসা সামগ্রীর অভাবে কার্যত বন্ধ। গাজায় শিশু খাদ্যের চরম সংকট, কিউবেটরের অভাব এবং আইসিইউ বিছানার সীমাবদ্ধতার কারণে প্রতিদিনই মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও বিতর্ক

গাজায় সাহায্য পাঠাতে যে প্রক্রিয়া চালু হয়েছে, তা নিয়েও আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল সমর্থিত ‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’ নামে একটি নতুন ত্রাণ বিতরণ ব্যবস্থা চালু হয়েছে। তবে জাতিসংঘসহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থা এতে অংশ নেয়নি।

তাদের মতে, এই উদ্যোগ মূলত ইসরায়েলি রাজনৈতিক ও সামরিক লক্ষ্য পূরণের একটি মাধ্যম। তারা বরং স্বাধীনভাবে এবং স্বচ্ছভাবে পরিচালিত ত্রাণ বিতরণ চায়।

ইসরায়েল যদিও বলছে, এই পদক্ষেপের মাধ্যমে তারা হামাস বিরোধী কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি মানবিক সহায়তাও নিশ্চিত করছে।

কী হতে পারে ভবিষ্যতে?

গাজায় সাময়িকভাবে কিছু সহায়তা প্রবেশ করলেও পরিস্থিতির কোনও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান এখনো হয়নি। মানুষের চিকিৎসার প্রয়োজন, খাদ্যের চাহিদা এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তা—সবকিছু এখনো ঝুঁকির মুখে।

বিশ্লেষকদের মতে, মানবিক সহায়তার গতি বাড়াতে হলে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় ও নিরপেক্ষ বিতরণ প্রক্রিয়া জরুরি। প্রশ্ন হচ্ছে—এই সহিংসতা আর কবে থামবে? মানুষ কবে পাবে মুক্তির নিঃশ্বাস?

এম আর এম – ০০৬৭, Signalbd.com

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button