ইসরায়েলি গুপ্তচরদের সঙ্গে আরও যাঁরা ইরানকে দুর্বল করছেন

২০২৫ সালের ১৩ জুন ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ একটি ভিডিও প্রকাশ করে, যা ইরানের ভিতরে ইসরায়েলি গুপ্তচরদের তৎপরতার নিদর্শন বহন করে। এই ভিডিওতে দেখা যায়, কিভাবে দুই ইসরায়েলি গুপ্তচর ইরানে প্রবেশ করে এবং লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালায়। দীর্ঘদিন ধরে মোসাদ ইরানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেদ করে গুপ্তচরবৃত্তির মাধ্যমে দেশটিকে দুর্বল করার কাজ করে আসছে। ইসরায়েলি গণমাধ্যমগুলো এই হামলাকে ‘অত্যন্ত নিখুঁত ও সুচারু পরিকল্পনার ফলাফল’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক হামজা আত্তার লুক্সেমবার্গ থেকে আল-জাজিরাকে জানান, ইরানের মধ্যে প্রায় ৩০ থেকে ৪০টি সক্রিয় গুপ্তচর সেল রয়েছে, যাদের অধিকাংশই সরাসরি মোসাদের গোয়েন্দা নয়, বরং স্থানীয় সহযোগী হিসেবে কাজ করে। এই সহযোগীরা ইসরায়েলি গোয়েন্দাদের অস্ত্র সরবরাহ, হামলা চালানো ও গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের কাজ করে ইরানের স্বার্থবিরোধী কার্যক্রমে লিপ্ত রয়েছে।
ইরানের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির বিরাট মাপে প্রতিরোধ ও পদক্ষেপ
ইসরায়েলি গোয়েন্দাদের কার্যক্রম থামাতে গত কয়েক দিনে ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী প্রায় ৭০০ জন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করেছে, যাদের মধ্যে অনেকেই ইসরায়েলের সঙ্গে সংযুক্ত। ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর উরমিয়ায় গতকাল বুধবার ইসরায়েলের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে তিন ব্যক্তির ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। এদের মধ্যে ইদ্রিস আলী, আজাদ শোজাই ও রসুল আহমদ রয়েছেন। বিচার বিভাগের বিবৃতিতে বলা হয়, তারা হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্যে দেশীয় অস্ত্র ও সরঞ্জাম প্রেরণ করছিলেন।
ইরানের গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, খুজেস্তান প্রদেশ থেকে ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সরকারি বার্তা সংস্থা তাসনিম জানিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনা হয়েছে।
কিভাবে ইসরায়েল ইরানের ভেতরে হামলা চালায়?
মোসাদের সর্বোচ্চ কর্তা ও সামরিক কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার থেকে জানা গেছে, এই হামলা ছিল বহু বছরের পরিকল্পনার ফল। ইসরায়েলি গোয়েন্দারা মানব গোয়েন্দা (HUMINT) ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) একযোগে ব্যবহার করে ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বড় অংশ অকার্যকর করে দেয়। হামলার লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণে যুক্তরাষ্ট্রের AI ভিত্তিক মডেল ও ইসরায়েলি গুপ্তচরদের সরবরাহ করা তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়।
ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র একাধিকবার ইরানে প্রবেশ করে নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানো হয়। গত কয়েক বছরে ইরানের শীর্ষ পর্যায়ের সামরিক কমান্ডার ও পরমাণুবিজ্ঞানীরা এই হামলায় নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে মোহসেন ফখরিজাদে অন্যতম।
ইসরায়েলি সামরিক গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞ মিরি আইসিন এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “অধিকাংশ মানুষ ইলেকট্রনিক যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না, তাই তাদের অবস্থান শনাক্ত করা সহজ হয়।” তাই ইরান শীর্ষ কর্মকর্তাদের ইন্টারনেট সংযুক্ত স্মার্টফোন ব্যবহার বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে, যাতে তাদের অবস্থান নির্ণয় কঠিন হয়।
প্রযুক্তি ও মানব গোয়েন্দার মিশ্রণ
শুধু মানব গুপ্তচর নয়, ইসরায়েল প্রযুক্তিও ব্যবহার করে ইরানকে দুর্বল করেছে। ২০১০ সালে স্টাক্সনেট নামক কম্পিউটার ভাইরাস ছড়িয়ে ইরানের অন্তত ১৪টি পারমাণবিক স্থাপনায় প্রায় ৩০ হাজার কম্পিউটার অকার্যকর করে দেয় মোসাদ। এছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও দূর থেকে পরিচালিত ড্রোন ব্যবহার করে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও ব্যক্তিত্বের উপর হামলা চালানো হয়েছে।
ইসরায়েলি গোয়েন্দারা পরমাণু বিজ্ঞানীদের অবস্থান সনাক্ত করে তাদের হত্যা করেছে। যেমন, গত ১৭ জুন আলী শাদমানির হত্যাকাণ্ড, এবং সাম্প্রতিককালে কুদস বাহিনীর দুই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সাঈদ ইজাদি ও বেহনাম শাহরিয়ারির লক্ষ্যভেদ।
গুপ্তচরবৃত্তির প্রভাব ও ভবিষ্যত
ইরানের ভেতরে ইসরায়েলি গুপ্তচরবৃত্তির ঘটনা নতুন নয়। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর থেকেই ইরানের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় নজরদারি ও গোপন অপারেশন চালানো হয়েছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির উপদেষ্টা ২০২৪ সালে স্বীকার করেছেন, গুপ্তচরবৃত্তি ইরানের জন্য একটি গুরুতর সমস্যা।
গত কয়েক বছরে ইসরায়েল ইরানে বিভিন্ন হামলা চালিয়েছে, যার মধ্যে তেহরানে হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়ার হত্যাকাণ্ডও উল্লেখযোগ্য। এসব হামলা এবং গুপ্তচরবৃত্তি ইরানের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ব্যাপক দুর্বলতা সৃষ্টি করেছে।
মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ ও প্রচারণার কৌশল
গুপ্তচরবৃত্তি গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে হলেও, ইসরায়েল প্রায়ই এসব তথ্য প্রকাশ করে শত্রুর মনোবল হ্রাস করার জন্য মানসিক যুদ্ধ পরিচালনা করে। হামজা আত্তার বলেন, “বারবার বলা হয়, আমি আপনার ঘরে ঢুকেছি, কিন্তু আপনি অস্বীকার করলে শেষ পর্যন্ত প্রমাণ দেখালে আপনার দুর্বলতা প্রকাশ পায়।”
ইসরায়েলি গোয়েন্দাদের এই প্রকাশনা কৌশল নিজ দেশের জনগণের মাঝে নিরাপত্তার ধারণা তৈরি করে এবং শত্রুর আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে।
ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এবং তাদের স্থানীয় সহযোগীদের মাধ্যমে ইরানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেদ করে বহু বছর ধরে পরিকল্পিত গুপ্তচরবৃত্তি ও সাইবার যুদ্ধ চালানো হচ্ছে। মানব গোয়েন্দা ও প্রযুক্তির মিশ্রণে তারা ইরানের শীর্ষস্থানীয় সামরিক ও পরমাণু বিজ্ঞানীদের লক্ষ্য করে নিখুঁত হামলা চালিয়েছে। ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী গ্রেপ্তার অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু সন্দেহভাজনকে আটক করেছে, কিন্তু এই গোপন যুদ্ধে এক ধরণের টানাপোড়েন চলছেই। এই সংঘাত কেবল সামরিক বা গোয়েন্দা নয়, বরং এতে রয়েছে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের কৌশলও।
ইসরায়েলি গুপ্তচর ও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ইরানকে দুর্বল করার এই গোপন যুদ্ধ ভবিষ্যতেও চলবে, যেখানে নিরাপত্তা, রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির জটিলতা অব্যাহত থাকবে।