বিশ্ব

তেহরানের তরুণদের জীবনযাত্রা: সংঘাতের মাঝে ডিজিটাল আশ্রয়

১৩ জুন ২০২৫ থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যকার সংঘাত তেহরানের তরুণ প্রজন্মের জীবনকে পাল্টে দিয়েছে। আতঙ্ক, ভীতি আর অস্থিরতার মাঝে ইরানের ‘জেন-জি’ প্রজন্ম ভার্চুয়াল দুনিয়ায় তৈরি করেছে তাদের নিজস্ব নিরাপত্তার ঠিকানা। বাস্তবের ঝুঁকি থেকে বিরত থেকে অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে তাঁরা খুঁজেছেন মানসিক শক্তি, বন্ধুতা এবং বেঁচে থাকার কৌশল।

ইসরায়েলি হামলার ছায়ায় তেহরানের জীবন: এক বিরল পরিস্থিতি

১৩ জুন ইসরায়েলের বিমান হামলার শুরুর পর থেকেই তেহরানের সাধারণ মানুষ বিশেষত তরুণ প্রজন্মের জীবন ব্যাহত হয়। আতঙ্কে অনেকে নিজ নিজ বাসায় নিরাপদ থাকার চেষ্টা করেন, কেউবা পরিবারের ছোট সদস্যদের নিয়ে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে ব্যস্ত থাকেন। রাত কাটানোর জন্য সাবওয়ে স্টেশনে আশ্রয় নেওয়া মানুষও ছিল কম নয়।

তবে তেহরানের জেন-জিরা বা ‘জেনারেশন জেড’ — যাদের বয়স ১২ থেকে ২৭ বছরের মধ্যে — এই পরিস্থিতিতে সরাসরি সাইবার দুনিয়াতেই নিজেদের আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে।

ডিজিটাল আশ্রয়: ভ্রমণহীন নিরাপত্তার জায়গা

আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তেহরানের তরুণরা বাস্তব জীবনে বের হতে না পারায় ভার্চুয়াল জগতে ঢুকে পড়েছেন। হোয়াটসঅ্যাপ, ডিসকর্ড, টেলিগ্রামসহ বিভিন্ন চ্যাটিং অ্যাপ প্ল্যাটফর্মে গড়ে উঠেছে একধরনের ‘ডিজিটাল আশ্রয়কেন্দ্র’। এখানে তারা একে অপরকে মানসিক সমর্থন দেন, বেঁচে থাকার কৌশল আলোচনা করেন, এমনকি বিনোদনের মাধ্যমে ভীতি ভুলানোর চেষ্টা করেন।

২৪ বছর বয়সী আইটি ছাত্র মোমো (ছদ্মনাম) জানালেন, “আমরা জানি না কখন কোথায় আবার হামলা হবে, পাশের বাড়িটি কী সরকারী কিংবা সামরিক সংস্থার অংশ কিনা, তবুও আমরা তেহরানে থেকে যাবো। এখানেই আমাদের জীবন, এখানেই আমাদের দায়িত্ব।”

সেন্সরশিপ আর বাধাবিপত্তি: কঠিন সময়ের পরীক্ষায় জেন-জি

ইরানে ২০২৪ সালের এপ্রিলে ডিসকর্ডসহ অনেক অনলাইন প্ল্যাটফর্ম নিষিদ্ধ করা হয়। সরকারি অভিযোগ ছিল, এসব অ্যাপ অশালীন কনটেন্ট ছড়ায়। তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, প্রকৃত কারণ ছিল এই প্ল্যাটফর্মগুলোতে প্রতিবাদ সংগঠিত হওয়া। তবুও, জেন-জিরা ভিপিএন ও এনক্রিপটেড যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে অনলাইনে সক্রিয় থাকার পথ খুঁজে পায়।

প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ ইরানি জেন-জি গেমার ও ডিসকর্ড ব্যবহারকারী। তাদের বড় অংশই এই কড়া নজরদারি এবং নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকে মানসিক সমর্থন ও সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে।

২৩ বছর বয়সী সামিন (ছদ্মনাম) বলেন, “সংঘাতের শুরুতে আমরা গেম খেলছিলাম, বিস্ফোরণের শব্দ শুনে প্রথমে বুঝতে পারিনি বাস্তব নাকি গেমের আওয়াজ। শেষ পর্যন্ত জানলাম, হামলা হচ্ছে।”

অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের জন্য অনলাইন ‘যোগব্যায়াম’ গ্রুপ

সংঘাতের ভেতর থেকে একটি অদ্ভুত মানবিক ছবি উঠে এসেছে তেহরানের অন্তঃসত্ত্বা নারীদের পাশে দাঁড়িয়ে। মায়ের আগামীর জন্য একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি হয়, যেখানে তারা একে অপরকে শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ, যোগব্যায়াম ও মানসিক সমর্থন দিয়ে সহায়তা করছিলেন।

২৮ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা জোহরা বলেন, “বিস্ফোরণের শব্দে ঘুম ভাঙলেও আমাদের গ্রুপের ভায়েস মেসেজ আর যোগব্যায়াম আমাকে শান্ত করত। কেউ কাউকে ভয় কাটানোর পরামর্শ দিত।”

এই গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে আমিনাহ ও জোহরা ছিলেন যারা যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন কার্ডধারী হলেও, পরিস্থিতির কারণে তেহরানে থেকে প্রেগন্যান্সির সময় পরিবারের পাশে থাকতে চেয়েছিলেন।

২০২২ সালের মাসা আমিনি প্রতিবাদ আন্দোলন: জেন-জিরার অনলাইন ক্ষমতা

২০১৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর কুর্দি তরুণী মাসা আমিনির পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর পর ইরানে ব্যাপক প্রতিবাদ শুরু হয়, যা অনলাইনের মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। জেন-জিরা সেই আন্দোলনের মুখ্য চালিকাশক্তি ছিল। সেন্সরশিপের মধ্যেও তারা ডিজিটাল মাধ্যমে নিজেদের ভাবনা, প্রতিবাদ ও সংহতি প্রকাশ করেছিল।

এখনো সংঘাত চলাকালীন সেই অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোই তরুণ প্রজন্মের কাছে সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র।

সংঘাতের সময়ে তরুণ প্রজন্মের মানসিক সংগ্রাম ও শক্তি

২৪ জুন যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসার পরেও তেহরানের জেন-জিরা সচেতন ও একাত্ম থেকেছে। তারা জানে, নিরাপত্তার জন্য কোনো সরকারি আশ্রয় নেই, কোনো সাইরেন নেই। তাদের একমাত্র আশ্রয় এখন একে অপরের মধ্যে, ডিজিটাল মাধ্যমে।

মোমো বলেছেন, “আমাদের জন্য এখন ঘরই আমাদের বেষ্টনী, আমাদের আত্মবিশ্বাস। আমরা জানি এই সংঘাত কতদিন চলবে না, তবে আমরা দাঁড়িয়ে থাকব।”

ইসরায়েল-ইরান সংঘাতের এই কঠিন সময়ে তেহরানের তরুণ প্রজন্মের ‘জেন-জি’ প্রমাণ করেছে যে, বাস্তব জীবনের বিপদ ও আতঙ্কের মাঝেও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কীভাবে শক্তি, সংহতি ও আশা তৈরি করা যায়। তারা ডিজিটাল দুনিয়াকেই করেছে নিজেদের আত্মার আশ্রয়স্থল।

এই সংগ্রাম শুধু একটা রাজনৈতিক বা সামরিক ঘটনা নয়, এটি মানুষের মানসিকতা, বন্ধুত্ব ও জীবনের প্রতি ভালোবাসার দৃষ্টান্ত। তাই তেহরানের তরুণদের এই ডিজিটাল যাত্রা বিশ্ববাসীর জন্য এক অনুপ্রেরণা এবং বর্তমান যুগের প্রযুক্তির শক্তির উদাহরণ।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button