নাটোয় জিডিপির ৫% প্রতিরক্ষা খরচে ঐক্যমত্য

দ্য হেগ, নেদারল্যান্ডস – পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর ৩২টি সদস্য দেশ তাদের জাতীয় আয় বা জিডিপির (GDP) ৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরে দুই দিনব্যাপী ন্যাটো সম্মেলনের সমাপ্তিতে। আগামী দশ বছরের মধ্যে এই পরিকল্পনা পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হবে বলে জোটভুক্ত দেশগুলো এক যৌথ বিবৃতিতে জানিয়েছে।
৫% জিডিপি প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের পটভূমি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরেই জোর দিয়েছিলেন যে, ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্য দেশগুলো যথাযথভাবে তাদের সামরিক বাজেট বাড়াতে হবে। তাঁর অবস্থান ছিল, যারা তাদের অংশ অনুযায়ী যথেষ্ট অর্থ প্রদান করছে না, তারা ন্যাটোর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ভারসাম্য রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ট্রাম্প একপর্যায়ে বলেছিলেন, যদি প্রয়োজন হয় তবে তিনি ন্যাটো থেকে বেরিয়ে যাবেন।
তাই এবারের সম্মেলনে প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পেয়েছিল। ট্রাম্প নিজেও সম্মেলনের শেষ দিনে এ বিষয়ে বলেন, “আমি মনে করি, এটি সবার জন্য একটি বিশাল বিজয়। আমরা খুব শিগগিরই সমতায় পৌঁছাব। আর এটাই হওয়া উচিত।” তিনি আরও বলেন, “আমি দীর্ঘদিন ধরে বলছি, ন্যাটোর সব সদস্য দেশকে তাদের জিডিপির ৫ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করতে হবে। এখন তারা সেই পথে চলছে।”
৫% জিডিপির প্রতিরক্ষা বাজেট কীভাবে ব্যয় হবে?
এই ৫ শতাংশ ব্যয়কে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। মোট জিডিপির ৩.৫ শতাংশ বরাদ্দ থাকবে সরাসরি সামরিক ও প্রতিরক্ষা খাতে যেমন সৈন্য নিয়োগ, সামরিক সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি উন্নয়ন। বাকি ১.৫ শতাংশ ব্যয় করা হবে সাইবার নিরাপত্তা, অবকাঠামো উন্নয়ন, এবং অন্যান্য নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট খাতে।
ন্যাটোর মহাসচিব মার্ক রুত্তে সাংবাদিকদের জানান, “নিরাপদ থাকতে হলে আমাদের আরও এগিয়ে আসতে হবে, এ বিষয়ে সব মিত্রদেশ একমত।” তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকেও গুরুত্ব দিয়ে বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোর প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকলেও ইউরোপের দেশগুলো এবং কানাডারও ‘ভার বহনের’ বড় একটি অংশ নিজেদের কাঁধে তুলে নিতে হবে।”
রাশিয়া হুমকি মোকাবিলায় ব্যয় বৃদ্ধির গুরুত্ব
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সিদ্ধান্তের পেছনে রয়েছে রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান সামরিক ও কূটনৈতিক হুমকি মোকাবিলার চাপ। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর থেকে পশ্চিমা দেশগুলো আরও শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। এছাড়াও সাইবার আক্রমণ ও তথ্যযুদ্ধের ভয়াবহতা বৃদ্ধির কারণে সাইবার নিরাপত্তার ওপর গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ন্যাটোর মিত্র দেশগুলো বলছে, ইউরোপীয় দেশগুলোর প্রতিরক্ষা বাজেট বৃদ্ধির মাধ্যমে তারা শুধু নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে না, বরং ন্যাটোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতা ও সহযোগিতা আরও মজবুত করবে। কারণ ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছিলেন, ইউরোপীয় দেশগুলো ন্যাটোর প্রতিরক্ষায় অপর্যাপ্ত অবদান রাখছে।
ইউরোপীয় নেতাদের প্রতিক্রিয়া
বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী বার্ট ডে ওয়েভার বলেন, “ইউরোপিয়ান হিসেবে আমাদের বোঝা উচিত, ইতিহাস থেকে আমাদের দীর্ঘবিরতি নেওয়ার দিন এখন শেষ।” তিনি আরও বলেন, “এই কঠিন সময়ে ইউরোপকে তার নিজস্ব নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে হবে।”
ন্যাটো সম্মেলনে আমন্ত্রণকারী নেদারল্যান্ডসের রাজা উইলেম আলেক্সান্দার ট্রাম্পের সম্মানে নৈশভোজে জানিয়েছেন, ট্রাম্প ফুরফুরে মেজাজে ছিলেন এবং সম্মেলনের সকল সদস্যদের মধ্যে ঐক্যের বার্তা তুলে ধরেছেন।
ভবিষ্যতে ন্যাটোর প্রতিরক্ষা নীতি ও কৌশল
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ন্যাটোর এই ৫% বাজেট বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র অর্থের ওপর সীমাবদ্ধ থাকবে না। এটি একটি সংকেত যে, ন্যাটো আরো সক্রিয় এবং আধুনিক প্রযুক্তি-নির্ভর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলবে। বিশেষ করে ড্রোন যুদ্ধ, সাইবার সিকিউরিটি, এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারে ন্যাটোর গুরুত্ব আরো বেড়ে যাবে।
ন্যাটো কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে, তারা ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মহাকাশ নিরাপত্তা, এবং সাইবার প্রতিরক্ষায় বড় ধরনের বিনিয়োগ করবে। এছাড়াও, নতুন সদস্য দেশগুলোর প্রশিক্ষণ ও সামরিক সক্ষমতা উন্নয়নেও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে।
কেন ৫% জিডিপি প্রতিরক্ষা বাজেট গুরুত্বপূর্ণ?
বিশ্বব্যাপী সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে চীন ও রাশিয়ার সামরিক আধুনিকায়নের পাল্লায় পশ্চিমা দেশগুলো পিছিয়ে থাকতে চায় না। তাই জিডিপির উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যয় করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি এই অর্থ বিনিয়োগ সামরিক শিল্প, প্রযুক্তি, এবং কর্মসংস্থানের জন্যও উপকারী হবে। ফলে দেশগুলোর অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
সংক্ষেপে:
- ন্যাটো দেশগুলো ২০৩৫ সালের মধ্যে জিডিপির ৫% প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করবে
- এই বাজেট দুই ভাগে ভাগ হবে: ৩.৫% মূল প্রতিরক্ষা, ১.৫% নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাত
- মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই সিদ্ধান্তকে ‘সবার জন্য মহান বিজয়’ বলে মন্তব্য করেছেন
- ইউরোপীয় দেশগুলোকে নিরাপত্তায় আরো অংশ নিতে হবে বলে গুরুত্বারোপ করেছেন ন্যাটোর মহাসচিব
- রাশিয়ার হুমকি মোকাবিলায় এই ব্যয় বৃদ্ধি অপরিহার্য
- ভবিষ্যতে আধুনিক প্রযুক্তি ও সাইবার সিকিউরিটিতে বিনিয়োগ বাড়ানো হবে
এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত যা আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা পরিবেশে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এই প্রেক্ষাপটে, ন্যাটো দেশের নিরাপত্তা ও সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বিশ্ব শান্তি ও স্থিতিশীলতার পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে।