বিশ্ব

ইরানে হামলাকে হিরোশিমায় পরমাণু বোমা ফেলার সঙ্গে তুলনা ট্রাম্পের

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন সামরিক হামলার সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা হামলার তুলনা করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনের এক সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া এই বক্তব্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

ট্রাম্প বলেন, “১৯৪৫ সালে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু হামলার পর যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটেছিল, তেমনি ইরানে সাম্প্রতিক মার্কিন হামলার মাধ্যমেই ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের অবসান হয়েছে। আমি সরাসরি হিরোশিমা-নাগাসাকির উদাহরণ দিতে চাই না, কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই মূলত যুদ্ধ শেষ হয়েছে। এমনটাই আমরা দেখতে পাচ্ছি।”

হামলার বিস্তারিত বিবরণ

২১ জুন রাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তিনটি ইরানি পারমাণবিক স্থাপনায় ‘সুনির্দিষ্ট ও ব্যাপক’ হামলা চালায়। ট্রাম্প জানান, ইরানের ফোর্দো পারমাণবিক স্থাপনা ছাড়াও আরও দুটি গোপন স্থাপনায় দূরপাল্লার সাবমেরিন থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়। “এই সাবমেরিনগুলো বিশ্বের শ্রেষ্ঠ অস্ত্র বহন করে। এগুলোর সমকক্ষ কিছুই নেই,” বলেন তিনি।

ট্রাম্পের ভাষ্য অনুযায়ী, এ হামলা ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তিনি বলেন, “এই সামরিক পদক্ষেপের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র শান্তির দ্বার খুলে দিয়েছে। আমরা ইরানের পরমাণু অস্ত্র অর্জনের পরিকল্পনায় বাধা দিয়েছি এবং একই সঙ্গে আমেরিকার সামরিক শক্তির প্রতি বিশ্বের বিশ্বাস ফিরিয়ে এনেছি।”

ইরানের প্রতিক্রিয়া

ট্রাম্প সংবাদ সম্মেলনে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি বিবৃতি পড়ে শোনান, যেখানে বলা হয়েছে—ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে গুরুতর ক্ষতি হয়েছে। তবে ইরানও চুপ ছিল না। মার্কিন হামলার জবাবে তারা কাতার ও ইরাকে অবস্থিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে মোট ১৪টি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। ট্রাম্প দাবি করেন, “আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ওই ১৪টি ক্ষেপণাস্ত্রের প্রতিটিই ভূপাতিত করেছে। ইরানকে আমরা সতর্ক করেছি।”

যুদ্ধবিরতির ঘোষণা

ট্রাম্প তার ঘোষণায় জানান, ইরান ও ইসরায়েল ‘সম্পূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ’ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে এবং এটি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কার্যকর হবে। ট্রাম্প তার ট্রুথ সোশ্যাল মিডিয়ায় বলেন, “আগামী ছয় ঘণ্টার মধ্যে দুই পক্ষ তাদের সামরিক অভিযান ধীরে ধীরে গুটিয়ে নেবে। আমি এটিকে বলছি ‘১২ দিনের যুদ্ধ’। এটা দীর্ঘমেয়াদি সংঘাত হতে পারত, কিন্তু আমরা সেটা হতে দিইনি।”

ট্রাম্পের ঘোষণার পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে এই যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানো হয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব বলেছেন, “এই যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়ন করা গেলে মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতার একটি নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে।”

কূটনৈতিক যোগাযোগ ও প্রচেষ্টা

সংঘাত চলাকালেও মার্কিন প্রশাসন কূটনৈতিক যোগাযোগ বজায় রেখেছিল বলে জানিয়েছে সিএনএন। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক দূত স্টিভ উইটকফ ইরানের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পরও এই কূটনৈতিক চ্যানেল বন্ধ হয়নি। এটি ছিল ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য একটি সেতুবন্ধন।

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না শিক্ষা?

ট্রাম্পের মন্তব্যে বিশ্বজুড়ে আলোচনার ঝড় উঠেছে। অনেকে বলছেন, হিরোশিমা ও নাগাসাকির মতো মানব ইতিহাসের অন্যতম মর্মান্তিক ঘটনা, যেখানে লাখ লাখ মানুষ নিহত ও আহত হয়েছিল, সেটির সঙ্গে বর্তমান সামরিক হামলার তুলনা করা অনুচিত। সমালোচকরা বলছেন, এ ধরনের মন্তব্য মানবিক দিক থেকে সংবেদনশীলতা হারানোর পরিচয় দেয়।

জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, “হিরোশিমা ও নাগাসাকি আমাদের জাতীয় ট্র্যাজেডি। এর সঙ্গে আধুনিক কালের সামরিক আক্রমণের তুলনা জাপানের জনগণের অনুভূতিতে আঘাত হানে।”

অন্যদিকে, ট্রাম্পের সমর্থকরা বলছেন, প্রেসিডেন্ট যুদ্ধ থামাতে যা করা প্রয়োজন, সেটাই করেছেন। মার্কিন নিরাপত্তা এবং মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া সময়োচিত ছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়া

মার্কিন কংগ্রেসের ভেতরেও বিষয়টি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। রিপাবলিকান নেতারা ট্রাম্পের পদক্ষেপকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার একটি বড় উদাহরণ বলে উল্লেখ করেছেন। তবে ডেমোক্রেটিক দলের নেতারা কংগ্রেসকে পাশ কাটিয়ে নেওয়া এই হামলাকে ‘গভীর উদ্বেগজনক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।

ডেমোক্রেট সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স বলেন, “আমরা হিরোশিমা থেকে কিছুই শিখিনি বলেই আজ আবার এমন মন্তব্য শুনতে হচ্ছে। যুদ্ধ কখনোই শান্তির পথ নয়।”

ইরান-ইসরায়েল সম্পর্ক কোন দিকে?

যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা এখন নজর রাখছেন দুই দেশের ভবিষ্যৎ কূটনৈতিক গতিপথের দিকে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বৈরিতা চলেছে। তবে ট্রাম্পের দাবি, এই যুদ্ধবিরতি ‘পূর্ণাঙ্গ শান্তি চুক্তির প্রথম ধাপ’। যদিও তা এখনও বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

উপসংহার

ইরানে মার্কিন হামলা এবং পরবর্তীকালে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা মধ্যপ্রাচ্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিতর্কিত হিরোশিমা-তুলনা নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে।

পরিস্থিতি এখন কিছুটা শান্ত হলেও ভবিষ্যৎ কী অপেক্ষা করছে, সেটি নির্ভর করছে আন্তর্জাতিক কূটনীতির ওপর। বিশ্বের নেতাদের দায়িত্ব এখন আরও সংযত ভাষা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করে এই শান্তি স্থায়ী করার পথে এগিয়ে যাওয়া।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button