ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস হয়নি, কেবল কয়েক মাস পিছিয়েছে

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির বর্তমান অবস্থা ও সাম্প্রতিক হামলার প্রভাব
২০২৫ সালের জুন মাসের শেষ দিকে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা নিয়ে একগুচ্ছ গোপন মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এই প্রতিবেদনের আলোকে জানা গেছে, মার্কিন ও ইসরায়েলি হামলার ফলে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি, বরং এটি কেবল কয়েক মাসের জন্য পিছিয়ে গেছে।
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন-ইসরায়েলি হামলার প্রেক্ষাপট
গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের যৌথ বিমান হামলায় ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক কেন্দ্র লক্ষ্য করা হয়। এগুলো হলো — ফর্দো, নাতাঞ্জ এবং ইসফাহান। বিশেষ করে ফর্দো স্থাপনাটি পাহাড়ের গভীরে অবস্থিত, যেখানে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের জটিল কাজগুলো চলে।
মার্কিন গোয়েন্দারা আগেই সতর্ক করেছিলেন, ইরান দ্রুত পারমাণবিক বোমা তৈরির চেষ্টা করলেও অন্তত তিন থেকে ছয় মাস সময় লাগবে। হামলার পরে প্রাথমিক মূল্যায়নে দেখা গেছে, ইরানের কর্মসূচি সর্বোচ্চ ছয় মাসের জন্যই পিছিয়ে গেছে। ফলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘সম্পূর্ণ ধ্বংস’ দাবি অতিরঞ্জিত বলে মনে হচ্ছে।
গোপন মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদন কী বলছে?
একটি পাঁচ পৃষ্ঠার গোপন মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ইরান হামলার আগেই তার গুরুত্বপূর্ণ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের অনেক অংশ গোপন স্থানে সরিয়ে নিয়েছিল। ফলে হামলায় ইউরেনিয়ামের ক্ষতি ছিল সামান্য। কিছু অংশ সম্ভবত ইরানের গোপন পারমাণবিক স্থাপনায় স্থানান্তরিত হয়েছে।
মার্কিন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা (ডিআইএ) মনে করছে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এখনও পুরোপুরি থেমে যায়নি। ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক মূল্যায়নে ইরানের পারমাণবিক ক্ষমতা কিছুটা দুর্বল হলেও তা পুনর্গঠন করতে তারা খুব বেশি সময় নেবে না।
ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের মতামত ও ইরানের গোপন স্থাপনাগুলো
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের ধারণা, ইরান মূল বড় স্থাপনা হামলার আশঙ্কায় গোপন ছোট ছোট ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র তৈরি করেছে। এর মাধ্যমে তারা বড় আকারের হামলার পরও পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে।
এছাড়াও ইসরায়েলি কর্মকর্তারা মনে করেন, ফর্দো স্থাপনার ভূগর্ভস্থ অংশ ধ্বংস হয়নি। মার্কিন গোয়েন্দারা এখনো বিস্তারিত ক্ষয়ক্ষতির চূড়ান্ত মূল্যায়ন করছেন।
যুক্তরাষ্ট্র ও হোয়াইট হাউসের বিবৃতি
হোয়াইট হাউস ডিআইএ-এর প্রাথমিক প্রতিবেদনের সঙ্গে একমত নয়। তাদের বক্তব্য, ‘৩০ হাজার পাউন্ডের ১৪টি বোমা নিখুঁতভাবে প্রয়োগের ফলে লক্ষ্যবস্তু সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে।’ হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র ক্যারোলাইন লেভিট বলেন, ‘এই প্রতিবেদনের ফাঁস প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে হেয় করার চেষ্টা।’
হামলার পর মার্কিন সেনাবাহিনীর ও কংগ্রেসের অবস্থান
মার্কিন জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল ড্যান কেইন বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে মারাত্মকভাবে দুর্বল করা।’ তবে ক্ষয়ক্ষতির চূড়ান্ত মূল্যায়ন এখনও বাকি। কংগ্রেসের কিছু সদস্য ব্রিফিং নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, কারণ তারা চান ক্ষয়ক্ষতির সম্পূর্ণ তথ্য জানা।
সেনেটর জ্যাক রিড বলেন, ‘আমরা ক্ষয়ক্ষতির চূড়ান্ত রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছি এবং সেটি জানা না গেলে আমাদের ভবিষ্যত পদক্ষেপ নির্ভর করবে না।’
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ভবিষ্যত
গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জানাচ্ছে, ইরান এখনো পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়নি, কিন্তু তাদের কাছে এত ইউরেনিয়াম রয়েছে যা দিয়ে খুব দ্রুত পারমাণবিক বোমা তৈরি করা সম্ভব। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়, তবে তা খুব দ্রুত করতে পারবে।
মার্কিন ও ইসরায়েলি হামলা ইরানের কর্মসূচিকে সাময়িকভাবে বাধাগ্রস্ত করলেও তা পুরোপুরি বন্ধ করতে পারেনি।
ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক উত্তেজনা ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ দীর্ঘদিন ধরেই বিরাজ করছে। পশ্চিমা দেশগুলো বারবার ইরানকে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম কমাতে এবং পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির থেকে বিরত থাকতে বলছে।
অন্যদিকে ইরান দাবি করে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ। তবে সাম্প্রতিক হামলাগুলো উত্তেজনা বাড়িয়েছে এবং ইরান প্রতিশোধের হুমকি দিয়েছে।
বিশ্ব সম্প্রদায় আশা করছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান যৌথ আলোচনা ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে পরিস্থিতি শান্ত করবে।
সংক্ষেপে
- ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস হয়নি, শুধু কয়েক মাসের জন্য কর্মসূচি পিছিয়েছে
- মার্কিন-ইসরায়েলি হামলায় ফর্দো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহান ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ভূগর্ভস্থ স্থাপনা অক্ষত রয়েছে
- ইরান আগেই গুরুত্বপূর্ণ ইউরেনিয়াম সরিয়ে নিয়েছিল, তাই ক্ষতি কম হয়েছে
- মার্কিন গোয়েন্দারা বলছেন, ইরান দ্রুত আবার পারমাণবিক কর্মসূচি পুনরায় চালু করতে সক্ষম
- ট্রাম্প প্রশাসনের ‘সম্পূর্ণ ধ্বংস’ দাবির পক্ষে গোপন প্রতিবেদন শক্ত ভিত্তি দেয়নি
- ইসরায়েলি কর্মকর্তারা ইরানের গোপন স্থাপনার অস্তিত্ব নিয়ে সতর্ক
- আন্তর্জাতিক মহলে উত্তেজনা থাকলেও কূটনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনাও রয়েছে