যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমস্যার সমাধানে প্রস্তুত ইরান: প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান

ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনার মধ্যে শান্তির আলো দেখতে চায় তেহরান। চলমান জটিল পরিস্থিতির উত্তরণে আন্তর্জাতিক কাঠামোর ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমস্যা সমাধানে প্রস্তুতির কথা জানিয়েছেন ইরানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে টেলিফোনালাপে এই বার্তা দিয়েছেন তিনি। ইরানের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আইআরএনএ এক প্রতিবেদনে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
এই মন্তব্য এমন এক সময় এল, যখন পারমাণবিক স্থাপনাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সঙ্গে ইরানের উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। একাধিক সামরিক হামলা, পাল্টা হামলা এবং কূটনৈতিক হুমকির মধ্যে প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ানের এই বার্তা মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতার একটি সম্ভাব্য ইঙ্গিত বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
শান্তির আহ্বান, আলোচনার প্রস্তাব
মাসউদ পেজেশকিয়ান বলেন, “আমরা যুদ্ধ চাই না। আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করেই আন্তর্জাতিক সমাজের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে আগ্রহী। যুক্তরাষ্ট্র যদি আন্তরিক হয়, আমরা আলোচনার জন্য প্রস্তুত।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন, ইরান কখনও আক্রমণাত্মক নীতি গ্রহণ করেনি, বরং বিদেশি আগ্রাসনের জবাবেই প্রতিক্রিয়া জানাতে বাধ্য হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ানের কণ্ঠে এমন কূটনৈতিক সংযম ইঙ্গিত দেয় যে নতুন প্রশাসন পূর্বসূরিদের তুলনায় তুলনামূলকভাবে বেশি কূটনৈতিক উদারতা দেখাতে পারে।
সৌদি যুবরাজের সঙ্গে ফোনালাপ: আঞ্চলিক সমঝোতার ইঙ্গিত
সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে ফোনালাপে প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারস্পরিক সহযোগিতার ওপর জোর দেন। পেজেশকিয়ান বলেন, “আঞ্চলিক দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষায় সৌদি-ইরান সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।”
দুই দেশের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক শক্তিশালীকরণের উদ্যোগ এই বার্তার পেছনে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে।
ট্রাম্পের পাল্টা মন্তব্য: যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টার দাবি
এদিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ন্যাটো সম্মেলনে যোগ দিতে নেদারল্যান্ডসের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে জানান, “ইসরায়েল এবং ইরান—দুই দেশই সমানভাবে যুদ্ধ থামাতে চেয়েছিল।” ট্রাম্প আরও বলেন, “সব পারমাণবিক স্থাপনা ও সক্ষমতা ধ্বংস করা এবং তারপর যুদ্ধ থামানোটা ছিল আমার জন্য বিশাল সম্মানের বিষয়!”
এ বক্তব্যে একদিকে তিনি নিজেকে শান্তির রূপকার হিসেবে উপস্থাপন করেন, অন্যদিকে যুদ্ধবিরতির আগে ইরান ও ইসরায়েল উভয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগও আনেন।
সাম্প্রতিক সংঘর্ষ ও উত্তেজনার পটভূমি
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ইরান, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পারমাণবিক স্থাপনা ও সামরিক ঘাঁটিতে পাল্টাপাল্টি হামলা অব্যাহত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’ নামে ইরানের ফোরদো, নাতাঞ্জ ও ইস্পাহান পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা চালায় বলে বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে।
এরপর ইরান একাধিকবার ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে, যার মধ্যে কিছুতে বেসামরিক স্থাপনায়ও আঘাত হানে। এই পরিস্থিতিতে কুয়েত ও বাহরাইন আকাশসীমা পুনরায় খুলে দিয়েছে, যদিও এখনও পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতির কোনও চুক্তি হয়নি।
জাতিসংঘ ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস আগেই সতর্ক করেছিলেন, “সংঘাত দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।” এর মধ্যে ইরান জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক চেয়েছে এবং চীন ও রাশিয়ার সমর্থনও পেয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক পরিসরে এখন আলোচনার গুরুত্ব বহুগুণে বেড়ে গেছে। মার্কিন প্রশাসনের একাংশ যদিও যুদ্ধপন্থার সমর্থক, তবু পেন্টাগন এবং ইউরোপীয় মিত্ররা শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষে একাট্টা।
পেজেশকিয়ানের কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ
ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও বিপ্লবী গার্ডের (আইআরজিসি) ভূমিকাকে পাশ কাটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় বসা পেজেশকিয়ানের জন্য সহজ হবে না। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি এখনও যুক্তরাষ্ট্রকে ‘বিশ্বাসযোগ্য নয়’ বলে অভিহিত করেন। তবুও রাষ্ট্রপতির বক্তব্যে কিছুটা হলেও ইতিবাচক বার্তা দেখা যাচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক হামিদ রেজা হাকিমি বলেন, “যুদ্ধের পরিসর নিয়ন্ত্রণে আনতে যদি প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান কোনও কূটনৈতিক চুক্তির পথে এগিয়ে যান, সেটি অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক—দুই চাপ মোকাবিলারই সাহসী প্রচেষ্টা হবে।”
উপসংহার
যখন মধ্যপ্রাচ্য এক রক্তাক্ত সংঘাতের মুখোমুখি, তখন ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ানের শান্তিপূর্ণ আলোচনার আহ্বান আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। যদিও বাস্তবতার কঠিন মাটিতে এই আশাবাদ কতটুকু টিকে থাকবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবুও কূটনৈতিক সংযম ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ—এই দুই ভিত্তিই হতে পারে মধ্যপ্রাচ্যের অশান্ত ভূখণ্ডে শান্তির সেতুবন্ধন।