বিশ্ব

কাতারে মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের হামলা অযৌক্তিক: সৌদি আরব

মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা নতুন মোড় নিয়েছে কাতারে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের আল-উদেইদ বিমানঘাঁটিতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। সোমবার (২৩ জুন) রাতে তেহরান এই হামলা চালায়, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। সৌদি আরব এই হামলাকে আন্তর্জাতিক আইন ও কূটনৈতিক সম্পর্কের নীতির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হিসেবে অভিহিত করে তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। একই সঙ্গে, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ইরানের সম্ভাব্য হামলার আশঙ্কায় সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে, এবং দেশটির আকাশসীমায় সকল বিমান চলাচল স্থগিত করা হয়েছে।

হামলার বিবরণ

ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) কাতারের রাজধানী দোহার কাছে অবস্থিত আল-উদেইদ বিমানঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এই ঘাঁটি মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটিগুলোর একটি, যেখানে ইউএস সেন্ট্রাল কমান্ড (CENTCOM)-এর ফরওয়ার্ড হেডকোয়ার্টার অবস্থিত এবং প্রায় ১০,০০০ মার্কিন সেনা মোতায়েন রয়েছে। হামলার সময় দোহার আকাশে বিস্ফোরণের তীব্র শব্দ শোনা যায়, যা রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে দেয়। ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে আইআরজিসি দাবি করেছে, এই হামলা যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক স্থাপনায় পূর্ববর্তী হামলার প্রতিশোধ হিসেবে চালানো হয়েছে। অপারেশনটির নাম দেওয়া হয়েছে “Annunciation of Victory”।

তবে, কাতারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সফলভাবে প্রতিহত করেছে। ফলে ঘাঁটিতে উল্লেখযোগ্য কোনো ক্ষয়ক্ষতি বা হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগও নিশ্চিত করেছে যে, এখন পর্যন্ত কোনো আমেরিকান সেনার হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

সৌদি আরবের প্রতিক্রিয়া

সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে এই হামলাকে “নিন্দনীয় এবং অযৌক্তিক” বলে অভিহিত করেছে। বিবৃতিতে বলা হয়, “ইরানের এই হামলা আন্তর্জাতিক আইন, জাতিসংঘের সনদ এবং কূটনৈতিক সম্পর্কের নীতির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এটি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ।” সৌদি আরব আরও জানিয়েছে, কাতার তাদের ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ এবং এই সংকটে রিয়াদ দোহার পাশে দাঁড়াবে। এর আগে, ২২ জুন ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলার ঘটনায়ও সৌদি আরব গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল।

সৌদি আরবের এই বক্তব্য মধ্যপ্রাচ্যের জটিল ভূ-রাজনৈতিক গতিশীলতার প্রতিফলন। একদিকে, সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে; অন্যদিকে, কাতারের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উন্নতি লাভ করেছে। এই হামলার ঘটনা এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলতে পারে।

কাতারের অবস্থান

কাতার সরকার এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাজেদ আল-আনসারি বলেছেন, “ইরানের এই হামলা কাতারের সার্বভৌমত্ব, আকাশসীমা এবং জাতিসংঘের সনদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। আমরা আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় এই আগ্রাসনের জবাব দেওয়ার অধিকার সংরক্ষণ করি।” তিনি আরও জানান, কাতারের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হামলা প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছে, এবং ঘাঁটিতে কোনো বড় ধরনের ক্ষতি হয়নি।

হামলার পর কাতার তাদের আকাশসীমা সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করে এবং প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা জোরদার করে। এই ঘটনা কাতারের জন্য একটি সংবেদনশীল বিষয়, কারণ দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সামরিক সহযোগিতা বজায় রাখলেও ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কও অক্ষুণ্ন রেখেছে।

ইরানের বক্তব্য

ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, এই হামলা কাতার বা এর জনগণের বিরুদ্ধে নয়। বিবৃতিতে বলা হয়, “আল-উদেইদ ঘাঁটিতে হামলা কাতারের আবাসিক এলাকা থেকে দূরে সুনির্দিষ্টভাবে মার্কিন অবস্থানে চালানো হয়েছে। আমরা কাতারের সঙ্গে আমাদের উষ্ণ ও ঐতিহাসিক সম্পর্ক বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।” ইরান আরও দাবি করেছে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের পারমাণবিক স্থাপনায় যে পরিমাণ বোমা ব্যবহার করেছিল, ঠিক ততগুলো ক্ষেপণাস্ত্র তারা এই হামলায় ব্যবহার করেছে, যা উত্তেজনা কমানোর ইঙ্গিত বহন করে।

ইরানের এই বক্তব্য বিশ্লেষকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। কেউ কেউ মনে করছেন, এটি একটি পূর্বপরিকল্পিত হামলা ছিল, যা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে চালানো হয়েছে। ২০২০ সালে ইরানের জেনারেল কাসেম সোলাইমানি হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে ইরাকের মার্কিন ঘাঁটিতে হামলার সময়ও ইরান আগে থেকে সতর্ক করেছিল। তবে, এই দাবির নির্ভরযোগ্য প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের সতর্কতা

ইরানের হামলার পর সংযুক্ত আরব আমিরাতে সম্ভাব্য হামলার আশঙ্কায় সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। দেশটির আকাশসীমা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, এবং সকল বিমান চলাচল স্থগিত করা হয়েছে। ফ্লাইটরাডারের তথ্য অনুযায়ী, আমিরাতের আকাশে বিমান চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। এই পদক্ষেপ মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার তীব্রতা প্রতিফলিত করে। আমিরাতে মার্কিন সেনাদের উপস্থিতি এবং আল-ধাফরা বিমানঘাঁটির মতো গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনা ইরানের সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তু হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউজে জরুরি বৈঠক ডাকা হয়। মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ জানিয়েছে, তারা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। এদিকে, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ বেশ কয়েকটি দেশ শান্তির আহ্বান জানিয়েছে এবং একটি বৃহত্তর যুদ্ধের আশঙ্কায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘের মহাসচিবও সংযমের আহ্বান জানিয়েছেন।

বিশ্লেষণ

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইরানের এই হামলা মধ্যপ্রাচ্যে একটি নতুন উত্তেজনার সূচনা করতে পারে। তবে, ইরানের বক্তব্য এবং কাতারের সফল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কারণে পরিস্থিতি তাৎক্ষণিকভাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়নি। এই ঘটনা যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে চলমান উত্তেজনার একটি অংশ, যা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এবং ইসরায়েল-ইরান সংঘাতের প্রেক্ষাপটে আরও জটিল হয়ে উঠেছে।

কাতারের জন্য এই হামলা একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখার চ্যালেঞ্জ। দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক জোট বজায় রাখার পাশাপাশি ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রাখতে চায়। সৌদি আরবের সমর্থন এবং আমিরাতের সতর্কতা এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সংহতির ইঙ্গিত দিলেও, ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় ঘেরা।

উপসংহার

ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা মধ্যপ্রাচ্যের ভঙ্গুর শান্তিকে আরও ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। সৌদি আরবের নিন্দা, কাতারের কঠোর প্রতিক্রিয়া এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সতর্কতা এই অঞ্চলের জটিল ভূ-রাজনৈতিক গতিশীলতার প্রতিফলন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সংযমের আহ্বান এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টাই এখন এই উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে। তবে, পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে, তা সময়ই বলে দেবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button