এ হামলা ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ কাতারের বিরুদ্ধে নয়: ইরান

ইরান কর্তৃক কাতারে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর তা নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। তবে ইরান এই হামলাকে কাতার বা তার জনগণের বিরুদ্ধে কোনো শত্রুতা নয় বলেই ব্যাখ্যা দিয়েছে।
ইরানের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা পরিষদের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “এই হামলা বন্ধুত্বপূর্ণ ও ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ কাতার বা তার সম্মানিত জনগণের জন্য কোনো হুমকি নয়। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান কাতারের সঙ্গে উষ্ণ ও ঐতিহাসিক সম্পর্ক বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
এই বিবৃতিটি এমন এক সময়ে এসেছে যখন মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। বিশেষ করে, ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান উত্তেজনা এই অঞ্চলে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। মার্কিন ঘাঁটিগুলোর ওপর ইরানের সাম্প্রতিক হামলা সেই উত্তেজনাকে আরও উস্কে দিয়েছে।
হামলার পটভূমি
ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি) আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে, তারা কাতারে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের আল উদেইদ বিমানঘাঁটি লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এই ঘাঁটিটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত, যেখানে প্রায় ১০ হাজার মার্কিন সেনা মোতায়েন রয়েছে।
তাসনিম নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একই সঙ্গে ইরাকের মার্কিন ঘাঁটিগুলোতেও একই ধরনের হামলা চালানো হয়েছে। ইরানের এই পদক্ষেপ স্পষ্টভাবে মার্কিন সামরিক উপস্থিতির বিরুদ্ধে একটি বার্তা বহন করে।
কাতারের প্রতিক্রিয়া
এই হামলার পর কাতার এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, দোহা ও ওয়াশিংটনের মধ্যে কূটনৈতিক যোগাযোগ জোরদার হয়েছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, কাতার এমন একটি অবস্থানে রয়েছে যেখানে একদিকে তারা যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদী মিত্র, অপরদিকে ইরানের সঙ্গে তাদের কূটনৈতিক সম্পর্কও দীর্ঘকালীন এবং সংবেদনশীল। ফলে এই হামলার ঘটনাটি কাতারের জন্য কৌশলগতভাবে অত্যন্ত জটিল পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষণ
বিশ্লেষক ড. আহসান মাহমুদ বলেন, “ইরানের এই হামলা সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হলেও এটি মধ্যপ্রাচ্যের কৌশলগত পরিমণ্ডলে কাতারকে অপ্রত্যাশিতভাবে বিপাকে ফেলেছে। যদিও ইরান কাতারকে সরাসরি লক্ষ্যবস্তু করেনি, তথাপি এই অঞ্চলে এমন হামলা কাতারের নিরাপত্তা এবং কূটনৈতিক ভারসাম্যে প্রভাব ফেলতে বাধ্য।”
তিনি আরও যোগ করেন, “এই ধরনের পদক্ষেপ ইরান তার ভূরাজনৈতিক অবস্থান জোরদার করতে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ বাড়াতে নিয়েছে। তবে এটি দীর্ঘমেয়াদে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে সামরিক উত্তেজনা আরও তীব্র করে তুলবে।”
যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় (পেন্টাগন) এখন পর্যন্ত কাতারে হামলার বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিস্তারিত বিবৃতি দেয়নি। তবে অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো জানিয়েছে, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে ঘাঁটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়েছে।
ওয়াশিংটন থেকে প্রতিক্রিয়া আসা শুরু হয়েছে, যেখানে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যরা এই হামলাকে ‘যুক্তরাষ্ট্রের ওপর সরাসরি হুমকি’ হিসেবে বর্ণনা করছেন।
মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক উপস্থিতি ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে কাতার, বাহরাইন, কুয়েত ও সৌদি আরবে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে রেখেছে। আল উদেইদ বিমানঘাঁটি এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই ঘাঁটি থেকে আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ায় পরিচালিত অনেক সামরিক অভিযানের দায়িত্বও নেওয়া হয়েছে।
এ কারণে ইরান যদি ভবিষ্যতেও এই ধরনের হামলা অব্যাহত রাখে, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতির ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে।
ইসলামি প্রজাতন্ত্রের কৌশলগত ভাষ্য
ইরান বারবার বলে আসছে, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ‘অবৈধ সামরিক উপস্থিতি’ এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার পথে প্রধান বাধা। সেই প্রেক্ষাপটেই তারা এসব সামরিক ঘাঁটিকে হামলার লক্ষ্য বানাচ্ছে।
কিন্তু এ ধরনের হামলার মাধ্যমে কি ইরান আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় করতে পারবে? নাকি এটি তাদের আরও বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দেবে—এই প্রশ্ন এখন বিশেষজ্ঞ মহলে আলোচনার কেন্দ্রে।
উপসংহার
ইরানের বক্তব্য অনুযায়ী, আল উদেইদ বিমানঘাঁটিতে হামলার উদ্দেশ্য কাতারের বিরুদ্ধে কোনো সামরিক বা রাজনৈতিক বার্তা নয় বরং মার্কিন সামরিক উপস্থিতির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করা। তবে এই ব্যাখ্যা দিয়েও তারা কি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হবে? বিশেষ করে কাতারের মতো এক বন্ধুসুলভ দেশকে অনিচ্ছাকৃতভাবে একটি সংকটের মধ্যে ফেলায়, ইরানের এই হামলা কতটা কৌশলগতভাবে ফলপ্রসূ হয়েছে তা সময়ই বলবে।