বিশ্ব

কাতার ও ইরাকে মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের হামলা

ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের মধ্যে কাতারের রাজধানী দোহায় একাধিক বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে, যা মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। স্থানীয় সময় রাত ৯:০১ টায় দোহার আকাশে ‘ক্ষেপণাস্ত্র ধরনের বস্তুর ঝলক’ দেখা গেছে এবং শহরজুড়ে বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা জানিয়েছে, এই বিস্ফোরণগুলো আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অংশ নাকি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, তা তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এই ঘটনার কয়েক ঘণ্টা আগে দোহায় অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস কাতারে থাকা মার্কিন নাগরিকদের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার জন্য সতর্কবার্তা জারি করেছিল।

এই সতর্কবার্তার পেছনে নির্দিষ্ট কোনো কারণ উল্লেখ না করলেও, বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলার প্রেক্ষিতে এই সতর্কতা জারি করা হয়েছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে চিঠি আদান-প্রদান এবং ইরানের পক্ষ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলার সম্ভাবনা উড়িয়ে না দেওয়ার ঘোষণা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করেছে।

দোহায় বিস্ফোরণ ও মার্কিন সতর্কতা

কাতারের আকাশসীমায় সন্দেহজনক বস্তুর উপস্থিতি এবং বিস্ফোরণের ঘটনার পর দেশটি সাময়িকভাবে তাদের আকাশসীমা বন্ধ ঘোষণা করেছে। দোহা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সাম্প্রতিক আঞ্চলিক উত্তেজনার প্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এছাড়া, নিরাপত্তার স্বার্থে কাতারের বেশ কিছু স্কুল আগামীকাল বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

দোহায় অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস এক ইমেইল বার্তায় জানিয়েছে, “প্রচুর সতর্কতার কারণে আমরা আমেরিকান নাগরিকদের পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি।” যুক্তরাজ্যের দূতাবাসও তাদের নাগরিকদের জন্য অনুরূপ সতর্কবার্তা জারি করেছে। কাতারে যুক্তরাষ্ট্রের আল উদেইদ বিমানঘাঁটিতে প্রায় ১০ হাজার মার্কিন সেনা মোতায়েন রয়েছে, যা মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের ফরওয়ার্ড হেডকোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই ঘাঁটির কৌশলগত গুরুত্বের কারণে এটি সম্ভাব্য হামলার ঝুঁকিতে রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের পটভূমি

গত ১৩ জুন ইসরায়েল ইরানের রাজধানী তেহরানসহ বিভিন্ন সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায় ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ নামে হামলা শুরু করে। এই হামলায় ইরানের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা, পারমাণবিক বিজ্ঞানী এবং বেসামরিক নাগরিকসহ অন্তত ৬৩৯ জন নিহত এবং ১৩২০ জন আহত হয়েছেন বলে হিউম্যান রাইটস অ্যাক্টিভিস্টরা জানিয়েছে। ইসরায়েলের দাবি, এই হামলার উদ্দেশ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ক্ষমতা রোধ করা।

পাল্টা জবাবে ইরান ১৪ জুন থেকে ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা শুরু করে। ইরানের ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি) ‘অপারেশন ট্রু প্রমিস-৩’ নামে এই অভিযান পরিচালনা করছে। ইরানের দাবি, তাদের ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের উন্নত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে তেল আবিব, জেরুজালেম, হাইফা এবং বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরসহ গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে। ইরানের রাষ্ট্রীয় টিভি জানিয়েছে, তেল আবিবে মোসাদের একটি কেন্দ্র এবং সামরিক গোয়েন্দা শাখা ‘আমান’-এর স্থাপনাও হামলার লক্ষ্য ছিল।

মার্কিন হামলা ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

২১ জুন রাতে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ফোরদো, নাতাঞ্জ এবং ইস্পাহান পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই হামলাকে ‘অসাধারণ সামরিক সাফল্য’ আখ্যায়িত করেছেন এবং দাবি করেছেন, ইরানের পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে। তবে, ইরানের দাবি, এই স্থাপনাগুলো হামলার আগেই খালি করা হয়েছিল এবং কোনো তেজস্ক্রিয় পদার্থ ছিল না। আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) নিশ্চিত করেছে, হামলার পর স্থাপনাগুলোর আশপাশে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা বাড়েনি।

রাশিয়া এই হামলাকে ‘আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন’ বলে নিন্দা জানিয়েছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন, এই হামলা জাতিসংঘ সনদ এবং পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) লঙ্ঘন করেছে। চীনের জাতিসংঘ দূত এই হামলাকে ‘বিপজ্জনক নজির’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

পুতিন-খামেনির চিঠি ও রাশিয়ার ভূমিকা

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা খামেনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনকে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন, যেখানে তিনি ক্রেমলিনের সহায়তা চেয়েছেন বলে রয়টার্স জানিয়েছে। পুতিন জানিয়েছেন, রাশিয়া ইরানের জনগণকে সহায়তা দিতে এবং শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচিতে সমর্থন দিতে প্রস্তুত। তিনি ইসরায়েল-ইরান সংকটের দ্রুত অবসানের জন্য মধ্যস্থতার প্রস্তাবও দিয়েছেন।

ইরানের আইআরজিসির মুখপাত্র সতর্ক করে বলেছেন, “জুয়াড়ি ট্রাম্প যুদ্ধ শুরু করতে পারেন, কিন্তু শেষ করব আমরা।” ইরান মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়নি, যা কাতারের আল উদেইদ ঘাঁটির মতো স্থাপনাগুলোকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া

জাতিসংঘ মহাসচিব সতর্ক করে বলেছেন, এই সংঘাত দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। আইএইএ ইরানের পরিস্থিতি নিয়ে জরুরি বৈঠক ডেকেছে। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ইরানকে আলোচনার টেবিলে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তুরস্ক মার্কিন হামলার সরাসরি নিন্দা না করে সংযত অবস্থান নিয়েছে, তবে আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

অর্থনৈতিক প্রভাব

ইরানে মার্কিন হামলার পর বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামে ঊর্ধ্বগতি দেখা গেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত অব্যাহত থাকলে তেলের দাম আরও বাড়তে পারে, যা বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য হুমকি। এছাড়া, ইরানে ৬০ ঘণ্টারও বেশি সময় ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন থাকায় দেশটির অর্থনৈতিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানিকে একটি গোপন চিঠি পাঠিয়েছেন, যার বিষয়বস্তু প্রকাশ করা হয়নি। কাতার ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে মধ্যস্থতার ভূমিকা পালনের চেষ্টা করছে, তবে দোহায় বিস্ফোরণের ঘটনা এই প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলতে পারে।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা খামেনি বলেছেন, “শত্রু বড় অপরাধ করেছে, শাস্তি পেতেই হবে।” ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ খামেনিকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন, যা সংঘাতকে আরও উসকে দিতে পারে।

মধ্যপ্রাচ্যের এই উত্তপ্ত পরিস্থিতি কূটনৈতিক সমাধানের পথে ফিরবে, নাকি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের দিকে এগোবে, তা এখনও অনিশ্চিত। তবে, কাতারের দোহায় সাম্প্রতিক বিস্ফোরণ এবং মার্কিন সতর্কবার্তা ইঙ্গিত দিচ্ছে, আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে যাচ্ছে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button