মার্কিন হামলার ইরানি প্রতিক্রিয়া দেখার অপেক্ষায় বিশ্ব

২০২৫ সালের ২২ জুন, রবিবার রাত গভীর বেলা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় ব্যাপক বোমা হামলা চালায়। হামলার কেন্দ্রবিন্দু ছিল তেহরানের কাছে অবস্থিত ভূগর্ভস্থ ফর্দো পারমাণবিক স্থাপনা, যেখানে উচ্চমাত্রার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি চলে। এই স্থাপনায় ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের ‘বাংকার-বিধ্বংসী বোমা’ প্রয়োগ করে মার্কিন সামরিক বাহিনী। এটি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের সবচেয়ে বড় সামরিক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ইরানের সরাসরি প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষা
মার্কিন এই হামলার একদিন পর, ইরান আত্মরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে এখনো তারা প্রত্যক্ষ প্রতিশোধমূলক কোনো পদক্ষেপ করেনি। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে স্পষ্ট করে দিয়েছেন, “আমরা প্রতিশোধ না নেওয়া পর্যন্ত কূটনীতিতে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়।” তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, “তারা আন্তর্জাতিক আইনকে মানে না, শুধু বলপ্রয়োগ ও হুমকির ভাষা বুঝে।”
মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা: ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধের নতুন অধ্যায়
এই হামলার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। ইসরায়েল পূর্বে ইরানের পশ্চিমাঞ্চলীয় সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে বিমান হামলা চালায়, জবাবে ইরান ইসরায়েলের তেল আবিব শহরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এতে বহু মানুষ আহত হন এবং বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়। ইসরায়েলি সামরিক মুখপাত্র জানিয়েছে, তাদের বিমান হামলার ফলে ইরানের সামরিক অবকাঠামো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ও নিরাপত্তা সতর্কতা
মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ দেশজুড়ে ‘উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি’ নিয়ে সতর্কতা জারি করেছে। সম্ভাব্য সাইবার হামলা, সহিংস বিক্ষোভ ও ধর্মীয় স্থাপনায় হামলার আশঙ্কায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জোরদার টহল দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। পাশাপাশি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিদেশে থাকা মার্কিন নাগরিকদের ‘অতিরিক্ত সতর্কতা’ অবলম্বনের জন্য বিশেষ পরামর্শ দিয়েছে।
ফর্দো পারমাণবিক স্থাপনার ক্ষয়ক্ষতি ও আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধান
বাণিজ্যিক কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে পাওয়া ছবি থেকে জানা গেছে, ফর্দো পারমাণবিক স্থাপনাটি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সেন্ট্রিফিউজও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তবে পরিমাণ ও প্রকৃত ক্ষতির বিস্তারিত তথ্য এখনও নিশ্চিত নয়। আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) জানায়, হামলার পর স্থাপনার আশপাশে তেজস্ক্রিয়ার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। সংস্থাটির মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি বলেন, “ক্ষতির প্রকৃতি ও পরিমাণ এখনো সঠিকভাবে নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি।”
ট্রাম্পের দ্বিধাস্পদ কূটনীতি ও রাজনৈতিক মন্তব্য
এই হামলার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার সোশ্যাল মিডিয়া ‘ট্রুথ সোশ্যালে’ একটি বিতর্কিত পোস্ট দেন, যেখানে তিনি বলেন, ‘সরকার পরিবর্তন’ শব্দটি রাজনৈতিকভাবে সঠিক নয়, কিন্তু বর্তমান ইরানি সরকার যদি দেশকে আবার মহান করতে না পারে, তাহলে কেন সরকার পরিবর্তনের কথা ভাবা হবে না? এর পাশাপাশি তিনি কখনো কূটনীতির মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান ঘটানোর প্রস্তাব দিয়েছেন, আবার কখনো নিজেই বড় ধরনের সামরিক হুমকি দিয়েছেন।
হরমুজ প্রণালির ভবিষ্যত: বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটের ঝুঁকি
ইরানের সবচেয়ে কার্যকর প্রতিশোধ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে হরমুজ প্রণালির মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধের হুমকি। ইরানের পার্লামেন্ট ইতিমধ্যেই হরমুজ প্রণালি বন্ধের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। এই প্রণালির মাধ্যমে পৃথিবীর প্রায় এক-চতুর্থাংশ তেল পরিবহন হয়। হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে যাবে, যা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও কূটনৈতিক পদক্ষেপ
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এই হামলার বিষয়টি নিয়ে জরুরি বৈঠক হয়েছে। রাশিয়া, চীন ও পাকিস্তান মধ্যপ্রাচ্যে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও শান্তি প্রক্রিয়া শুরু করার প্রস্তাব দিয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, “মধ্যপ্রাচ্যের এই সংকট একটি বিপজ্জনক মোড় নিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে।”
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও স্পষ্ট করেন, “ইরান আবারও যদি সমস্যা তৈরি না করে, তাহলে নতুন কোনো সামরিক অভিযান পরিকল্পনা নেই।”
ভবিষ্যত দিকনির্দেশনা
এই সংঘাতের পরিণতি বিশ্ব রাজনীতিতে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপ এবং তেল প্রণালির ভবিষ্যত সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো সমাধান এখনও নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানের মধ্যে উত্তেজনা যদি আরও বাড়ে, তবে পুরো মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতাই বিপন্ন হবে। বিশ্ব সম্প্রদায় এখন ইরানের প্রতিক্রিয়ার ওপর কপালে হাত রেখে অপেক্ষা করছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই সামরিক পদক্ষেপ মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক আইন, কূটনীতি এবং মানবিক মূল্যবোধকে সামনে রেখে সমাধানের পথ খোঁজা না গেলে, ভয়াবহ সংঘাত ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে পুরো বিশ্বকে। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে সকল পক্ষের জন্য শান্তি প্রতিষ্ঠার তাগিদ অপরিহার্য।