হরমুজ প্রণালী চালু রাখতে চীনকে পাশে চায় আমেরিকা

বিশ্ব বাণিজ্যের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ, হরমুজ প্রণালী বন্ধের হুমকি দিয়ে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি করেছে ইরান। ইরানের পার্লামেন্ট ইতোমধ্যেই এই প্রণালী বন্ধ করার প্রস্তাব অনুমোদন করেছে, যা আন্তর্জাতিক তেলের বাজার এবং বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখন ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের হাতে রয়েছে।
হরমুজ প্রণালী কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
হরমুজ প্রণালী বিশ্ব বাজারে তেলের সরবরাহের ক্ষেত্রে একটি অপরিহার্য নৌপথ। প্রায় ২০ শতাংশ বৈশ্বিক জ্বালানি তেল এই প্রণালীর মাধ্যমে পরিবহন হয়। এই সরু প্রণালীটি পারস্য উপসাগরের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে অবস্থিত, যা মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে সংযুক্ত করে।
ইরান কেন বন্ধ করতে চায় হরমুজ প্রণালী?
ইরান পূর্ব থেকেই পশ্চিমা দেশগুলোর চাপ এবং নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি। দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আন্তর্জাতিক মানচিত্রে নানা অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে ইরান মাঝে মাঝে হরমুজ প্রণালী বন্ধের হুমকি দিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে চায়। এ বছরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর ইরানের পার্লামেন্টে এই প্রণালী বন্ধের প্রস্তাব উত্থাপিত হয় এবং অনুমোদিত হয়েছে।
ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড বাহিনীর একজন কমান্ডার ইসমাইল কোসারি বলেছেন, “হরমুজ প্রণালী বন্ধ করা আমাদের প্রধান আলোচ্য বিষয়। প্রয়োজন হলে তা কার্যকর করা হবে।”
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চিন্তা ও পদক্ষেপ
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও দ্রুত এই সংকটের সমাধানে পদক্ষেপ নিতে চায়। তিনি চীনের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন যাতে তারা ইরানকে হরমুজ প্রণালী বন্ধ থেকে বিরত রাখতে আলোচনা চালায়। কারণ চীন নিজেও এই প্রণালীর ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।
রুবিও ফক্স নিউজকে বলেছেন, “ইরান যদি প্রণালী বন্ধ করে, তা হবে বড় একটি ভুল, যা তাদের অর্থনীতির জন্য আত্মহননস্বরূপ। যদিও আমাদের বিকল্প পথ আছে, তবু বিশ্বের অন্যান্য দেশের অর্থনীতি এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
তিনি আরও বলেন, “প্রণালী বন্ধ হলে উত্তেজনা আরও বাড়বে এবং আমরা সহ অন্যান্য দেশ প্রতিক্রিয়া দেখাব।”
চীনের ভূমিকা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে চীন মধ্যপ্রাচ্যের তেলের প্রধান ভোক্তা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। ইরান ও চীনের মধ্যে কৌশলগত ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক দিন দিন দৃঢ় হচ্ছে। এ কারণেই মার্কো রুবিও বিশেষভাবে চীনের প্রতি আর্জি জানিয়েছেন যাতে তারা ইরানের সঙ্গে কথা বলে এই প্রণালী বন্ধের পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করে দেয়।
তবে, এখন পর্যন্ত চীনের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। ওয়াশিংটনের চীনা দূতাবাস থেকে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য মেলেনি।
বিশ্ব বাণিজ্যের ওপর প্রভাব
হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে তা শুধু মধ্যপ্রাচ্যের তেল সরবরাহ ব্যাহত করবে না, বরং বিশ্ব অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে যাবে, যা জ্বালানি ও পণ্যের দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তুলবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা জরুরি।
হরমুজ প্রণালী: ইতিহাস ও বর্তমান অবস্থা
হরমুজ প্রণালী শতাব্দী ধরে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পথ হিসেবে পরিচিত। এটি পারস্য উপসাগরের তেল সমৃদ্ধ দেশগুলোর তেল বিশ্বের বাজারে পৌঁছানোর প্রধান মাধ্যম। ১৯৮০ ও ১৯৮৮ সালের মধ্যে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় এই প্রণালী দিয়ে নৌপথে হামলার ঘটনা ঘটেছিল, যা নৌবাণিজ্যে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছিল।
বর্তমানে, প্রায় ২০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল দৈনিক এই নৌপথের মাধ্যমে পরিবহন হয়, যা বিশ্বজুড়ে জ্বালানির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অপরিহার্য।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যত পরিস্থিতি
ইরানের হুমকি ও পার্লামেন্টের সিদ্ধান্তের পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদ্বিগ্ন। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান ও অন্যান্য তেল আমদানিকারক দেশ হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে দ্রুত এবং কঠোর প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে।
বিশ্বব্যাপী শক্তিশালী নৌবাহিনী ও সামরিক জোট এই নৌপথের নিরাপত্তা রক্ষায় ইতিমধ্যে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে আমেরিকা ও যুক্তরাজ্য তাদের নৌবাহিনী প্রণালী অঞ্চলে মোতায়েন রেখেছে।
বিশ্ব শান্তি ও বাণিজ্যের স্বার্থে হরমুজ প্রণালী বন্ধের হুমকি থেকে বিরত থাকা অত্যন্ত জরুরি। ইরান ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে এই সংকট নিরসন করা সম্ভব।
বিশ্বের প্রধান শক্তিগুলোকে একসাথে কাজ করে এমন কোনো সমঝোতার পথ খুঁজে বের করতে হবে, যা হরমুজ প্রণালীকে স্থায়ীভাবে নিরাপদ রাখবে এবং তেলের বিশ্ববাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখবে।
- ইরান পার্লামেন্ট হরমুজ প্রণালী বন্ধের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে।
- চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখন ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের হাতে।
- মার্কো রুবিও চীনের কাছে অনুরোধ করেছেন ইরানকে প্রণালী বন্ধ থেকে বিরত রাখতে।
- হরমুজ প্রণালী বিশ্বজুড়ে তেলের প্রায় ২০% পরিবহন করে।
- প্রণালী বন্ধ হলে বিশ্ব অর্থনীতি ও নিরাপত্তা বড় ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
- চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, তবে এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।
হরমুজ প্রণালী ও বিশ্ব অর্থনীতির ভবিষ্যৎ: এক বিশ্লেষণ
হরমুজ প্রণালী বন্ধের হুমকি বিশ্ববাজারে তেলের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়াবে। এটি মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি স্বরূপ। এই সংকট মোকাবিলায় বিশ্ব সম্প্রদায়ের একতা ও কূটনৈতিক উদ্যোগ অপরিহার্য। বিশেষ করে চীন ও আমেরিকার মতো শক্তিধর দেশগুলোর ভূমিকা সমাধানে মুখ্য হতে পারে।